নাগেরবাজার থেকে খানিকটা এগোলে একটা বড়ো মাঠের পাশে বাড়িটা। দরজার ওপরে উঁকি দিচ্ছে একটা বিড়াল, আরেকটা বসে আছে জানলার কার্নিশে। সৃজনদার বাড়ি যখন ঢুকছি, তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। বয়স ৭৫ পেরিয়ে গেছে বছর দুয়েক আগেই, কিন্তু এখনও যে-কোনো বয়সের ছেলেমেয়ের কাছেই তিনি ‘সৃজনদা’। বয়স তো একটা সংখ্যা মাত্র। বাড়িতে ঢুকতেই প্রথম চোখ টানল সারা ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোটো-ছোটো প্ল্যাকার্ডে ছড়ার টুকরো বা কবিতার অংশ। কোথাও রবীন্দ্রনাথের লেখা, আবার কোথাও জার্মানির প্রাচীন প্রবাদ। দরজার বাইরেই লেখা—‘গোমড়ামুখো যারা, যেন আসে না কভু তারা’। বাথরুমে লেখা ‘যার যেখানে ইচ্ছে/ কেইবা উঁকি দিচ্ছে!’ মানুষটিকে চেনা যায় এইভাবে। মানুষ অবশ্য দু’জন। ঘর ভর্তি বই, আর তার মাঝখানে সংসার ভাস্বতীদি-সৃজনদার।
ঘরে বই আর পোস্টারের মাঝে বসে সৃজনদা। আমাদের দেরি হওয়ায় খানিক উৎকণ্ঠিত। কলেজস্ট্রিট যেতে হবে, মিটিং। বয়স তাঁর জীবনীশক্তিতে সামান্য কামড়ও বসাতে পারেনি। তাই হয়তো এখনো তুলে নেন রং-তুলি, ঘণ্টার পর ঘণ্টার যত্নে বানান অসামান্য সব পোস্টার। আর সেইসব পোস্টার আর সদ্য লেখা ছড়া নিয়েই সামিল হন মিছিলে। শহরে সাম্প্রতিক এনআরসি-সিএএ বিরোধী মিছিলে সৃজনদার পোস্টারের সামনে ভিড় জমিয়েছেন বহু মানুষ। তাঁর পোস্টারের ছবি ভাইরাল সোশাল মিডিয়াতেও।
পোস্টারের সঙ্গে সৃজনদার সম্পর্ক অবশ্য নেহাত কমদিনের নয়। নিজেকে বলেন গণ-আন্দোলনের কর্মী। সেই পঞ্চাশের দশকে ট্রাম-ভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁর বয়স বছর দশেক। ষাট বছরের বেশি সময় ধরে কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যের আবহমান আন্দোলনের আঁচে নিজেকে বারবার উষ্ণ করে নিয়েছেন তিনি। পোস্টার তাঁর ভাষ্য, বলা ভালো অস্ত্র। এখনো আন্দোলনের ঢেউ উঠলেই কাগজ কেটে, রং-তুলি নিয়ে বসে যান পোস্টার তৈরির কাজে। বিভোর শিল্পীকে দেখে কে তখন বলবে বুড়ো!
সৃজন সেন নিছক পোস্টার-শিল্পী নন। সত্তরের দশকের উত্তাল সময়ে লেখা ‘থানা গারদ থেকে মাকে’ কাব্যগ্রন্থটি নাড়িয়ে দিয়েছিল অনেককেই। কবিতা লেখার সমান্তরালেই বয়ে গেছে প্রচ্ছদ আঁকাও। অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন সৃজন সেন। আর এই সবটার পাশাপাশি সৃজনদার অন্যতম পরিচয় তাঁর পোস্টার। ডিজিটাল দুনিয়ায় এখনো রং-তুলি-লেটারিং আর কাগজ-আঠার সম্পর্ক পাতিয়েই পোস্টার তৈরি করেন সৃজনদা। সেই পোস্টার দেখে চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে পথচলতি কিশোর-কিশোরী থেকে বৃদ্ধরাও।
পোস্টারের কথা উঠতেই সৃজনদার চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ভাঁড়ার থেকে বেরোতে শুরু করে একের পর এক পুরনো পোস্টার। সেখানে গণবিজ্ঞান-লোকবিজ্ঞান বিষয়ক পোস্টার আছে, তার সঙ্গে আছে হিরোশিমা-নাগাসাকি পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে পোস্টার, ভাষা আন্দোলনের পোস্টার, জিএম শস্যের বিরুদ্ধে পোস্টার, আর অবশ্যই অসংখ্য আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক পোস্টার। সৃজনদার বাড়ি সদ্য রং হয়েছে। সংরক্ষণের অসুবিধা হচ্ছিল বলে গ্রাম-মফঃস্বলের অনেককে তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন পোস্টার। চেয়েছেন তাঁর পোস্টার দেশের প্রান্তরে প্রান্তরে মানুষের অধিকারের লড়াইয়ের অস্ত্র হয়ে উঠুক।
পোস্টার যেহেতু অস্ত্র, তাই তার ব্যবহার নিয়েও বড়ো খুঁতখুঁতে তিনি। এলেবেলে করে যেকোনো জায়গায় যেকোনো পোস্টার মারতে দেখলে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন। সৃজনদা বলেন, পোস্টারের নিজস্ব বিজ্ঞান আছে। কোথায় কতটা আলো, কোথায় মানুষ দ্রুত হেঁটে যায়, কোথায় থমকে থামে -- এই সবকিছু মাথায় রেখে একটি পোস্টার গড়ে তুলতে হয়। সেই বুঝে ব্যবহার করতে রং, ছোটো-বড়ো হয় হরফ। পোস্টার বানানো এতই সহজ নাকি! তাকে সময়ের ভাষ্য হয়ে উঠতে হবে, রোদ, বৃষ্টি, আলো সহ্য করে টিকেও থাকতে হবে দীর্ঘদিন।
পোস্টারের সঙ্গেই জুড়ে থাকে ছড়া। এনআরসি সিএএ নিয়ে পাঁচালিও বেঁধেছেন তিনি। ‘থানা গারদ থেকে মাকে’, ‘প্রিয়তমাসু’, ‘তিন প্রেমিকের গান-এর মতো কবিতার কবিই জন্ম দিয়েছেন ‘হল’ এবং ‘লিমেরিক’। দুটিকে মিলিয়ে তিনি নাম দিয়েছেন হুলিমেরিক। সৃজনদা বলছিলেন, “ছড়ার কথা মানুষের কাছে পৌঁছোয় বেশি।” অনেক গম্ভীর কথাও তাই ছড়ার ছলে বলে দেওয়া যায়। মাও সে তুং-এর মৃত্যুতে তিনি তাই লিখে ফেলেন,
“মরিয়াছে ব্যাটা
চুকিয়াছে ল্যাটা
এবার আমরা ছাড়িয়া হাঁপ,
সাজায়ে গুছায়ে
আসনে বসায়ে
ব্যাটারে বানাবো ধর্মবাপ”।
কবিতা বা শিল্পকে পেশা বানাননি তিনি। পেশার কথা জিজ্ঞেস করলেই বলেন, ‘আমি তো বেকার।’ দুজনের যৌথ সংসারে সৃজনদাকে তাঁর শিল্পের জগৎ নিয়ে মেতে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন ভাস্বতীদি। ভাস্বতী ঘোষ, নৈহাটি ঋষি বঙ্কিম কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপিকা ছিলেন। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত। তিনি নিজেও সামাজিক আন্দোলনের কর্মী। আন্দোলন ও রাজনীতির সূত্রেই পরিচয় দুজনের। তারপর প্রেম এবং বিয়ে। নয় নয় করে বেশ অনেকগুলি বছর কাটিয়ে দিলেন একসঙ্গে। এখনও এই দোতারা নিটোল সুরে বাজে। সৃজনদার সৃষ্টিতে, উদ্দীপনায় যেন সামান্য ভাঁটাও না পড়ে, তার জন্য সংসারের অর্থনৈতিক দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন ভাস্বতীদি। এও তো লড়াইতে জুড়ে থাকাই, ভিন্ন মাধ্যমে। ঘরের কোথাও সামান্য ময়লা জমতে দেন না দুজনে। ময়লা জমতে দেন না মনেও। উৎসাহী সকলের জন্য অবারিত দ্বার এই বাড়িতে। ভাস্বতীদি-সৃজনদার বাড়ি যেন একটুকরো মরূদ্যান।
কথা বলার মাঝেই কফি দিয়ে গেলেন ভাস্বতীদি। সময়ের অভাবে আর বেশি কথা বলা গেল না। এই সামান্য কথায় কতটুকুই বা ধরা যায় মানুষটাকে। অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার চুঁইয়ে নামছে হাজারো গল্প। দাদা-বৌদির সঙ্গে আসবেন বলে একটা হাফপ্যান্ট পরে পালিয়ে এসে উঠেছিলেন ট্রেনে। সেই যে শেষবারের মতো ভিটে ছেড়ে আসা, ভাবেননি। কলকাতার কত রঙ যে তিনি চেনেন। দাঙ্গা-দেশভাগ থেকে নকশালবাড়ি আন্দোলন, ইমার্জেন্সির সময় পেরিয়ে ভিড় জমায় অজস্র স্মৃতি। শহরটা বদলে গেল চোখের সামনে। সময়টাও বদলাচ্ছে রোজ। এখনো কোথাও আন্দোলনের খবর পেলে ছুটে যান সৃজনদা। সঙ্গে থাকে পোস্টার। সেগুলি মানুষের হাতে তুলে দেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। নতুন সম্পর্ক পাতানোয় তাঁর বড়ো লোভ। আমাদের বলছিলেন, “আমি তো বিশেষ পার্টির সমর্থক নই। তাই সিপিএম, কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি - যখন যে ক্ষমতায় থেকেছে, আমি পোস্টার এঁকেছি। আমি পোস্টার এঁকেছি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, ইরাকে যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আমার লড়াই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।”
বয়স বাড়ছে। মাঝে মাঝে পা টলে যায়। এখনো একটিও মিটিং মিস করেন না। এখনো সময়ের অভিঘাতে মাটিতে বসে যান। কাগজ কাটেন, বর্ডার দেন। এখনো তুলিতে তাঁর লেখা সামান্য এঁকেবেঁকে যায় না। তাঁর মতাদর্শ, পোস্টারের বক্তব্য নিয়ে ভিন্নমত থাকতেই পারে কারো। কিন্তু তাঁর পোস্টার চোখ টানবেই। চিরযুবক সৃজন সেন এমনই থাকুন। উষ্ণতায়, উৎসাহের চিরযৌবনে…