ফর্সা, একটু স্বাস্থ্যবান, শার্প একটি চেহারা। সঙ্গে গোলাপি ঠোঁট— একেবারে নায়কোচিত ব্যাপার। সত্তর-আশির দশকে বলিউডের ‘চকোলেট বয়’-এর ভূমিকায় মাঠে নামেন তিনি। এটা সত্যি, তাঁর বাবার নাম ‘দ্য’ রাজ কাপুর। বলিউডের রাজকীয় কাপুর পরিবারের তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু ঋষি কাপুর এসব ভাবতেন না। অভিনয়টা জানতেন, করতেনও। সেই সময়ের রোম্যান্টিক হিরো থেকে পরবর্তীতে পুলিশ অফিসার, গ্যাংস্টারের চরিত্র— ‘চিন্টুজি’ সবেতেই সাবলীল। ‘রাজ কাপুরের ছেলে’ হিসেবেই আটকে থাকেননি; ঋষি কাপুর নামেই হিন্দি সিনেমার জগতে উজ্জ্বল হয়ে আছেন তিনি। আর থাকবেনও…
ঋষি কাপুরকে এক ফ্রেমে ধরতে চাইলে চালচিত্রে কী কী উঠে আসবে? একজন দক্ষ অভিনেতা, ফ্যামিলি ম্যান, কৌতুক-প্রিয়; এবং অবশ্যই স্পষ্টবক্তা। তাঁর বিগত কয়েক বছরের টুইট থেকেই তাঁর আন্দাজ পাওয়া যায়। সমস্ত ঘটনা নিয়ে নিজের যা মনে হত, সেটাই বলতেন। কোনো রাখঢাক নেই। সেটা পছন্দও করতেন না ঋষি। তাই নিজের আত্মজীবনীর নামও দিয়েছিলেন ‘খুল্লম খুল্লা’। অনেক সময় রোষের মুখেও পড়েছেন এর জন্য, কিন্তু তাতে থোড়াই কেয়ার। তিনি নিজেই তো ‘আনসেন্সরড’!
জীবনের প্রথম ছবি ‘মেরা নাম জোকার’। ওইরকম কালজয়ী একটি সিনেমায় শিশু চরিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয় জাতীয় পুরস্কার এনে দেয় কাপুর পরিবারের ট্রফি ক্যাবিনেটে। ১৬ বছর বয়সে প্রথম ছবি, আর সেটাই কিনা জাতীয় পুরস্কার! মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু ঘোরেনি। বলিউডের লাভার বয় হিসেবে তৈরিই হয়ে যান ঋষি। তাঁর ওই লুক, ওই হাসিতে পাগল সবাই। সেই ‘পাগলামি’ থেকেই সম্পর্ক, ও প্রেম, সর্বোপরি বিয়ে। ঋষি কাপুর ও নীতু সিং— অনস্ক্রিন, অফস্ক্রিন দুটোতেই বলিউডের অন্যতম সফল জুটি।
সেই সময় বলিউডের অনেকের জীবনেই জুড়ে থাকতেন কোনো না কোনো বাঙালি। ঋষি কাপুরের জীবনেও ছিলেন একজন। রাধু কর্মকার। শুধু ঋষিই নন, রাজ কাপুরের সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল নিবিড়। পেশায় রাধুবাবু ছিলেন বলিউডের অন্যতম সফল সিনেমাটোগ্রাফার। রাজ কাপুরই তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন মুম্বইতে। বিখ্যাত আর কে স্টুডিও’র সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। ঋষি কাপুরের প্রথম অভিনীত ছবি ‘মেরা নাম জোকার’ই হোক, বা প্রথম হিরোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ‘ববি’— সবেতেই অন্যতম প্রধান মানুষটি ছিলেন রাধু কর্মকার। ঋষি কাপুরের প্রথম দিকের প্রায় সব সিনেমার সঙ্গেই জুড়ে ছিলেন তিনি। পেয়েছিলেন জাতীয় পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডও।
খানিক আগেই বলা হল ‘খুল্লম খুল্লা’র কথা। ঋষি কাপুর নিজের জীবনকে প্রায় উজাড় করে দিয়েছেন বইতে। তাঁর এবং ছেলে রণবীর কাপুরের বেশ সাক্ষাৎকার থেকেও জানা যায় আরও অনেক ঘটনা। ‘সঞ্জু’-তে রণবীর কাপুর সঞ্জয় দত্তের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। বাস্তবে যখন তিনি কিশোর, বলা ভালো যৌবনের প্রায় শুরু দিকে, তখন সঞ্জয়ের রীতিমতো ভক্ত ছিলেন। তিনিও রণবীরকে নিয়ে ঘুরতে যেতেন রাতে। আর সেখানেই প্রবল আপত্তি ছিল ঋষি কাপুরের। এতটাই সেই আপত্তির তেজ, একদিন নিজে নাকি সঞ্জয় দত্তকে ফোন করে ধমকে দেন। তারপর থেকে যোগাযোগ কমে আসে। কঠোর মনে হলেও, ঋষি যে ‘খুল্লম খুল্লা’; যা মনে হয়েছে, যেটা ঠিক মনে হয়েছে, সেটাই করেছেন।
নিজের বাবাকেও ছাড়েননি ঋষি কাপুর। রাজ কাপুরের সঙ্গে অনেক নায়িকার সম্পর্কের খবর শোনা যায়। ঋষি কাপুর সেইসব দিনের কথাও বলে গেছেন। কীভাবে তাঁকে আর তাঁর মা, কৃষ্ণা কাপুরকে অসহায় অবস্থায় পড়তে হয়েছিল… নার্গিস, বৈজয়ন্তীমালা’র মতো অভিনেত্রীদের সঙ্গে নাম জড়িয়েছিল রাজ কাপুরের। কিন্তু তাঁর মায়ের এখানে কোনো জায়গা ছিল না। দুঃখ কি থেকে গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত? না বোধহয়; কারণ রাজ কাপুর যে শুধু তাঁর বাবা নয়, তাঁর গুরুও। বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে সম্পর্কের সময় ছোট্ট ঋষি কাপুরকে নিয়ে কৃষ্ণাদেবী অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ফিরেও এসেছিলেন। কিন্তু সেই দাগটুকু আজীবন বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বলিউডের চিন্টু।
পরের দিকে ঋষি কাপুর ‘ডি ডে’ বলে একটি ছবিতে গ্যাংস্টারের চরিত্রে অভিনয় করেন। যে চরিত্রের অনুপ্রেরণা ছিল ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ দাউদ ইব্রাহিম। ঋষি নিজেও দু’দুবার দাউদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন! অবশ্য নিজের ইচ্ছায় নয়। একবার ১৯৮৮ সালে দুবাইতে এক বন্ধু তাঁকে নিয়ে যান দাউদের বাড়ি। খাওয়া দাওয়ার পর ঋষিকে আর্থিক সাহায্যের ‘অফার’ করেন তিনি। এর পরের বছরই মুম্বইয়ের একটি দোকানে আবার দেখা ‘ডন’-এর সঙ্গে। সেবারও একই অফার আসে দাউদের তরফ থেকে। বলা বাহুল্য, দুবারই সরাসরি নাকচ করে দেন ঋষি।
জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিনয়ে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন ঋষি। কিন্তু ক্যানসার সেই যাত্রায় থাবা বসাল। সুস্থও হয়ে উঠছিলেন; তাঁর অসামান্য কিছু অভিনয়ও দর্শকরা দেখেছিল রুপোলী পর্দায়। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। করোনার এই বিধ্বস্ত সময় গতকালই চলে গেলেন অভিনেতা ইরফান খান। আর আজ, ঋষি কাপুরও। ঘটা করে নয়, মৃত্যুর সামনে সটান গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি যে লাভার বয়, আবার ‘খুল্লম খুল্লা’…