সময়টা পঞ্চাশের দশক। উৎপল দত্তের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হচ্ছে ‘সাংবাদিক’ নাটক। সেখানেই সংবাদপত্র বিক্রেতার চরিত্রে অভিনয় করছেন একজন বেঁটে খাটো, শ্যামলা ছেলে। কিন্তু বেশ শক্তিশালী চেহারা। মঞ্চের একদিক দিয়ে ঢুকে, অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া— এটিই ছিল ওই নাটকে তাঁর ভূমিকা। যারা জাত অভিনেতা, তাঁরা তো এই সামান্য সময়, সামান্য চরিত্রেই নিজেকে প্রমাণ করেন। তেমনই করেছিলেন তিনি। নাটক দেখতে এসেছিলেন মৃণাল সেন। ওইটুকু অভিনয় দেখেই, মুগ্ধ তিনি। অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদারের পথ চলা সেদিন থেকেই শুরু। অবশ্য এই নাম বললে অনেকেই চিনবেন না। গোটা ভারতের কাছে যে তিনি এক এবং অদ্বিতীয় রবি ঘোষ। বাঙালি পায় তাঁর চিরদিনের ‘বাঘা’-কে।
অভিনয় ছিল তাঁর রক্তে। কলেজে পড়ার সময় থেকেই নাটক করা শুরু। বন্ধুদের নিয়ে আশুতোষ কলেজের ছাদে চলত তাঁর দল ‘বন্ধুমন’-এর মহড়া। কিন্তু বাড়িতে মহা সমস্যা। এমন শরীর নিয়ে কি আর অভিনয় হয়! অত কিছু ভাবলেন না রবি। অবশ্য অভিনয় ছাড়া আরও একটা নেশা ছিল তাঁর; শরীরচর্চা। হয়ত বডি বিল্ডারই হতেন। সেটা যে হয়নি শেষ পর্যন্ত, আমাদের সৌভাগ্য…
অবশ্য চেহারার জন্য বিপদেও পড়তে হয়েছে মাঝেমধ্যে। বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হবে ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’। সত্যজিৎ রায়, তপেন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গেছেন রবি ঘোষও। শপিং করতে গিয়ে বেশ বিড়ম্বনাতেই পড়লেন তিনি। জার্মানদের জামা তাঁর গায়ে কিছুতেই আঁটছে না। মহা মুশকিলে পড়ল সবাই। শেষে এক জার্মান মহিলা তাঁকে নিয়ে গেলেন ছোটোদের জায়গায়। শেষে সেই জামা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন রবি ঘোষ। তখন অবশ্য মহা আনন্দে তিনি।
‘তিন ভুবনের পারে’-র একটা দৃশ্য কেউই ভুলতে পারেনি। ভুলতে পারেনি সেই এভারগ্রিন গান ‘জীবনে কি পাবো না…’। সেখানে দুজনের নাচ আজও অনেকের স্মৃতিতে তাজা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবি ঘোষ। এই দুজনের কথা এলেই সামনে আসে আরও একটি সিনেমা- ‘হীরক রাজার দেশে’। পরবর্তীকালে নানা সময় অভিন্নহৃদয় বন্ধু রবি’র কথা বলেছেন সৌমিত্র। প্রথম আলাপ ১৯৬১ সালে, স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। সৌমিত্র’র কথায়’ “প্রথম দর্শনেই ওকে আমার ভাল লেগে গিয়েছিল। চেহারাটা সত্যিই ওর চোখে পড়ার মতো ছিল। সেটা ওর মাথায় খাটো মাপের হওয়ার জন্যই কিন্তু নয়। ওর ব্যায়ামে মজবুত চমৎকার শরীরে একটা লাবণ্য ছিল। মুখটা ছিল অত্যন্ত অভিব্যক্তিময়। আর চোখদুটো এত উজ্জ্বল যে তা লোককে আকর্ষণ করবেই। ওর গলার আওয়াজটাও আমার প্রথম দিন থেকেই খুবই ভাল লেগেছিল। সব মিলিয়ে একটা জ্যান্ত মানুষ।”
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এই ‘জ্যান্ত মানুষ’ মঞ্চে বা পর্দায়ও ছিলেন সমান জীবন্ত। কৌতুকাভিনেতা হিসেবেই তাঁকে চিনেছে বাঙালি। সেটা দেখতে গিয়ে তাঁর প্রাণবন্ত অভিনয়ও কি আমরা এড়িয়ে যাই? নিজেও এই তকমায় বিশ্বাসী ছিলেন না কখনও। পেশাদারিত্ব, পড়াশোনা ও সময়জ্ঞান— সবসময় এই জিনিসগুলোকে গুরুত্ব দিতেন তিনি। বাবা মারা যাওয়ার পর পরই তিনি যোগ দিয়েছেন নাটকের দলে। সময়ের আগেই পৌঁছে যেতেন শুটিং ফ্লোরে। সারাক্ষণ সঙ্গী থাকত ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ আর প্রবন্ধের বই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, অত্যন্ত ‘ডিসিপ্লিনড’ একজন অভিনেতা তিনি। অনায়াসে চরিত্রের মধ্যে ঢুকে সেই মানুষটি হয়ে যান। খুব সহজ মনে হলেও, সেটা করতে কতটা অধ্যাবসায় লাগে, তা বারবার স্মরণ করেন তাঁর সতীর্থরা। রবি ঘোষ তাই একজনই থেকে যান আমাদের কাছে। কখনও ‘ধনঞ্জয়’, কখনও ‘শেখর’, কখনও বা ‘বাঘা হয়ে’…
ঋণ স্বীকার-
১) অগ্রপথিকেরা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
২) আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০১৩, ‘নাটক আমার স্ত্রী, সিনেমা আমার ফিঁয়াসে’
৩) ডেইলি স্টার বাংলা, ‘তোমার পোলারে কয়া দিও ওই চেহারায় অভিনয় হয় না’
Powered by Froala Editor