অন্যদের বারণ সত্ত্বেও উড়ান, মাত্র ৫৩ বছরেই বিমান-দুর্ঘটনায় মৃত জন ডেনভার

ভার্জিনিয়া এলাকার পাথুরে রুক্ষ আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে ঘুরে বেড়াত গানটা। ‘কান্ট্রি রোডস টেক মি হোম, টু দ্য প্লেস আই বিলং’। গানের সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের ঘাসপাতা থেকে ভীষণ রোদে পোড়া একটা গন্ধ এসে ঝাপটা মারত মুখে। কাছের নদীটার নাম ছিল শেঁনাডোয়া, খনিতে হাড়ভাঙা খাটুনির শ্রমিক পরিবারগুলোর হাসি-কান্না মিশে যেত উঁচু নীল পাহাড়গুলোতে। এইসব প্রকৃতি, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া মানুষগুলোর কথাই উঠে আসত তাঁর গানে। আর সেইসবই আরও ভাল ভাবে দেখার জন্যই হয়তো কিংবদন্তি জন ডেনভার নিজেই বিমান চালিয়ে উঠে যেতেন পাখির দৃষ্টিকোণে।

১২ অক্টোবর, ১৯৯৭। সেদিন বিকেল পাঁচটা বেজে আঠাশ মিনিটে মন্টারি পেনিনসুলা অঞ্চলের বেশ কিছু মানুষ অবাক হয়ে দেখেন, একটি বিমান মাথা নিচু করে ঝুঁকে আসছে সমুদ্রের দিকে। বিমানটির চালক জন ডেনভার এবং বিমানটি ছিল তাঁর নিজেরই আদ্রিয়ান ডেভিস লং ইজেড।

নিজে বেশ নামী বিমানচালক ছিলেন ডেনভার। অভিশপ্ত সেই ১২ অক্টোবরেও ব্যক্তিগত বিমানটি নিয়ে উড়ান দিয়েছিলেন পাহাড় জঙ্গল বনভূমির উপর দিয়ে। বারণ করেছিলেন বিমানবন্দরের অন্যান্য বিশেষজ্ঞেরা। প্রয়োজনীয় জ্বালানি নাকি ছিল না বিমানের মধ্যে। তাই সেই ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলা হলেও, অনেকেই যার মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনাও।

বস্তুত, একাধিক বিমানের মালিক ছিলেন ডেনভার। ফৌজিতে থাকা আর্মি অফিসার বাবাকে দেখেই বিমান চালনার ব্যাপারে প্রাথমিক আগ্রহ তাঁর। পরবর্তীতে একটার পর একটা অ্যালবাম বেরনোর পর, গানের জন্যই বিমানচালনাকে অগ্রাধিকারের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে ঠেলে দিতে হয়। কিন্তু সময় পেলেই বেরিয়ে পড়তেন যে কোনো একটা সাধের বিমানকে সঙ্গী করে। পুরনো, ভিন্টেজ বিমান সংগ্রহের শখ ছিল ডেনভারের। উপরে উঠতে উঠতেই হয়তো ডেনভার বুঝতে চেয়েছিলেন প্রিয়জনের থেকে দূরে চলে যাওয়ার যন্ত্রণা। ‘...ও বেব, আই হেট টু গো’।

আরও পড়ুন
১৪টি দেশের ৩২৫ জন শিল্পী জুড়লেন গানে, লকডাউনে বিশ্বরেকর্ড ভারতীয় সুরকারের

ডেনভারের গানে ঘুরেফিরে এসেছিল ভালবাসা আর প্রতিবাদ। প্রতিবাদের উপকরণ হিসেবে ছিল সেই বিমান, শিকারি পাখি, দিগন্তহীন আকাশ, উপর থেকে দেখা রুক্ষ কিংবা সবুজ পৃথিবীর টুকরো। তবে এই প্রতিবাদের আগুন তীব্র তীরের মতো না এসে যেন আসত একাকী সন্ধের মনখারাপের ধাঁধার মতো। চারণ কবিদের মতো সহজাত গুণেই ডেনভারের গানের মধ্যেও উঠে এসেছে সহজ-সরল কথাই। ‘রাইমস অ্যান্ড রিসার্চ’ দিয়ে যাত্রা শুরু হয়ে যাঁর একের পর এক অ্যালবামের শিরোনাম হিসেবে হিসেবে উঠে এসেছে ‘পোয়েমস্, প্রেয়ারস্ অ্যান্ড প্রমিসেস্’, ‘ফেয়ারওয়েল অ্যান্ড্রোমিডা’, ‘সিজনস্ অফ দ্য হার্ট’, ‘আই ওয়ান্ট টু লিভ’, ‘ক্রিসমাস লাইক আ লুলাবি’, ‘ড্রিমল্যান্ড এক্সপ্রেস’, ‘উইন্ড সং’ কিংবা ‘দ্য ফ্লাওয়ার দ্যাট শ্যাটার্ড দ্য স্টোন’।

আরও পড়ুন
গান্ধীজির মৃত্যুতে গান থুড়ি নতুন রাগ বাঁধলেন রবিশঙ্কর

ভালবাসতেও শেখাননি কি ডেনভার আমাদের? ‘তোমার হাসিতে ডুবে যেতে রাজি, রাজি তোমার পায়ে মরে যেতে’। যেন দেখা হওয়ার পর প্রিয়জনকে হাত নেড়ে একা হতে হতে ফিরে আসা ক্রমশ। সেই মানুষটাই বাতাসের সঙ্গে নাচতে নাচতে শেষ যাত্রা করবে না তো কে করবে? যেন নিজের জন্যই সাজিয়ে রাখা এপিটাফ, ‘ইফ আই শুড লিভ ফরএভার, অ্যান্ড অল মাই ড্রিমস্ কাম ট্রু, মাই মেমোরিজ্ অফ লাভ উইল বি অফ ইউ’। ভালবেসেই উড়তে চেয়েছিলেন ডেনভার। সেই ভালবাসাই কাল হয়ে নেমে এল তাঁর জীবনে। সেভাবে দেখতে গেলে তাঁর নিজস্ব জীবনকে ডেনভারের থেকে ভাল আর কেউই লিখে যেতে পারেননি— ‘লাভ ইজ নাউ দ্যা রিজন আই মাস্ট গো’।

আরও পড়ুন
ধনঞ্জয়ের 'একবার বিদায় দাও মা' গানের কথা বদলে গেল লতার কণ্ঠে

অন্তত ৬৪ বছর অবধি কি বাঁচতে চেয়েছিলেন ডেনভার? গানে অন্তত সেই কথাই বলা আছে যেন। ‘উইল ইউ স্টিল নিড মি, উইল ইউ স্টিল ফিড মি, হোয়েন আই অ্যাম সিক্সটি ফোর?’ অথচ মাত্র ৫৩ বছর বয়সেই অপেক্ষার উড়ান থেমে গেল ডেনভারের। কাঁধের উপর, চোখের উপর সমস্ত রোদ্দুর নিয়ে, বুড়ো গিটারের সমস্ত অপেক্ষা সম্বল করে, রকি মাউন্টেন আর কলোরাডো অঞ্চলের সাজানো গ্রামগুলোর পথ ধরে আজীবন সেইসব প্রাণ দিয়ে ভালবেসে যাওয়া মানুষটা চলে গেল শুধু বুকের বাঁ-দিক চিনচিন করে ওঠা একঝাঁক প্রশ্ন রেখে, “আমি খুব বুড়ো হয়ে যাওয়ার পরেও ভ্যালেন্টাইনে আমাকে ওয়াইনের বোতল পাঠাতে ভুলবে না তো, প্রিয়তমা?”

একটা সময় বিতর্ক বা আলোচনা উঠেছিল চরমে, যদি পঞ্চাশের দশক এলভিস প্রিসলির হয়, আর ষাটের দশকটা বিটলসের, তবে সত্তরের দশকটা চোখ বুজে দিয়ে দেওয়া উচিৎ হেনরি জন দুশেনডর্ফ জুনিয়রকে। হেনরি জন দুশেনডর্ফ জুনিয়র, পরবর্তীতে যে পরিচিত হবে জন ডেনভার নামে, বড় হওয়ার পুরো সময়টাতেই তাঁকে ঘিরে ছিল গান এবং উড়োজাহাজ। আমেরিকান এয়ারফোর্স অফিসারের সন্তান হেনরি জনকে একটা গিবসনের অ্যাকোয়াস্টিক গিটার উপহার দিয়েছিলেন তাঁর ঠাকুমা। গান এবং বিমান নিয়ে এই দোলাচল সারা জীবনই সঙ্গী হয়েছিল জন ডেনভারের। চার দেওয়ালের গণ্ডির মধ্যে পড়াশোনাতেও মন বসল না সেভাবে। তিন বছর যেতে না যেতেই টেক্সাস টেকনিক্যাল কলেজ থেকে পড়াশোনায় ইতি দিয়ে পাড়ি জমালেন নিউইয়র্কে। ‘মিশেল ট্রায়ো’ কিংবা ‘পিটার, পল অ্যান্ড মেরী’র মতো দল ডেনভারের গান রেকর্ড করার পর থেকেই হুহু করে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে ডেনভারের। কলোরাডো অঞ্চলেও পরে ডেনভারের ‘রকি মাউন্টেন হাই’ স্বীকৃতি পায় সেখানকার ‘স্টেট সং’ হিসেবে।

বিভিন্ন পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী রক্ষা সংগঠন এবং মানবতাবাদী বিভিন্ন সংস্থার জন্যেও প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ করতেন ডেনভার। ন্যাশনাল স্পেস ইনস্টিটিউট, সেভ দ্য চিলড্রেন ফাউন্ডেশন অথবা ফ্রেন্ডস অফ দ্য আর্থ এর মতো বিভিন্ন সংস্থার সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭৭ সালে নিজে উদ্যোগ নিয়ে গঠন করেছিলেন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার প্রোজেক্ট।

কিন্তু সব সময় মানুষের সঙ্গে থাকা ডেনভার আকাশে উড়তে চাইতেন একা একাই। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, একা না হলে নাকি আকাশের সঙ্গে ‘কমিউনিকেট’ করতে অসুবিধা হয়! ১৯৯৭ সালের ১২ অক্টোবরের সেই দিন মন্টারি পেনিনসুলা বিমানবন্দর থেকে উড়ান দেন ডেনভার। যদিও বিমানবন্দরের আধিকারিকেরা জানান, যে বিমানটি নিয়ে ডেনভার উড়ান দেন সেটির অতীত রেকর্ড ছিল রীতিমতো ভয়াবহ। প্রায় ৬১ বার দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিল এই ধরনের বিমান, যার মধ্যে উনিশটি ছিল প্রাণঘাতী।

উড়ানের আগে ডেনভারকে বারবার বলা হয়েছিল, সমস্যা আছে সেই বিমানের হাতলটিতে। কিন্তু কোনও বারণে কান না দিয়ে ডেনভার সেই বিমানের ডিজাইনারকে বলেছিলেন, পরবর্তী উড়ানের আগে সেটাকে ঠিক করে দিতে। সেই সময় উড়তে নিষেধ করা হলে বলেছিলেন, “কীই বা হবে, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসবো তো!” আশ্চর্যজনক ভাবে, বারংবার বলা সত্ত্বেও বিমানের ট্যাংকিতে জ্বালানি ভর্তি করে নিতেও অস্বীকার করেন তিনি। আরও একটি ধাঁধাঁ হল, সেই সময় ডেনভারের উড়ানের লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত হয়েছিল আগে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর অপরাধে। তবু কেন তাঁকে বিমান চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, সেই নিয়ে খটকা জাগা খুবই স্বাভাবিক।

যদিও একাধিক পাইলট এবং বিমান বিশেষজ্ঞ অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছেন পুরো ঘটনাটিকে। বিমান চালক এবং ঘটনাচক্রে দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটির ডিজাইনারের বাবা জর্জ রুটান বলেছিলেন, “ওইভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার একটাই মানে হতে পারে, আপনার মনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু আমরা যারা ডেনভারকে চিনি, তাদের কাছেই ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য যে তিনি এই ঘটনা ঘটাতে চাইবেন।” একটা গোটা সন্ধে কেটে যাবার পর সেদিন অনুসন্ধানকারীরা সমুদ্রের ২৫ ফিট তলা থেকে খুঁজে পান ডেনভারের মাথাসহ শরীরের অন্যান্য বিচ্ছিন্ন অংশ।

যদিও এই অস্বাভাবিক মৃত্যু ছাপিয়ে এখনও গানের সহজ-সরল সুরে আর কথাতেই ডেনভার ছড়িয়ে আছেন কান্ট্রি রোডস আর শেঁনাডোয়া নদীর কলকল ছাড়িয়ে বিশ্বের প্রতিটা কোণায় তাঁর অসংখ্য অনুরাগীর মনে। উঁচু উঁচু পাহাড়, বনভূমি, নদী, সমুদ্র, উপত্যকা, গিরিখাত প্রেম ছিল যে মানুষটার, পার্বত্য কলোরাডো অঞ্চলের প্রকৃতি ভরে আছে যাঁর গানে, তাঁকে ‘কান্ট্রি বয়’ বানানোর জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে যে গাইত ‘লাইফ ইজ নাথিং বাট আ ফানি রিডল’, তাঁর দেহ, দেহের সমস্ত অংশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে সেই প্রকৃতির মধ্যেই— ডেনভারের ক্ষেত্রে অন্তত এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল বোধ হয়!

Powered by Froala Editor

More From Author See More