মতানৈক্যে ঘরছাড়া উদয়শঙ্কর; মৃত্যুর আগে আবার এক হয়েছিলেন অমলা-র সঙ্গে

১৯৩১ সাল। প্যারিসে নাচের শো করতে সপরিবারে গেছেন উদয়শঙ্কর। তখনই কতই বা বয়স তাঁর, শরীরে তারুণ্যের রক্ত টগবগিয়ে ফুটছে। মা হেমাঙ্গিনীর সঙ্গে রয়েছেন ভাই রবিও। সেখানেই এসে পড়ল যশোরের এক গ্রাম্য কিশোরী। দু’চোখে নাচের স্বপ্ন, হাতে দৃপ্ত মুদ্রা। এগারো বছর বয়সী সেই কিশোরী মুগ্ধ হয়ে দেখলেন এক পুরুষের নৃত্যকৌশল; যার প্রথাগত কোনো শিক্ষা ছিল না। ছিল এক নিজস্বতা, ছিল শিল্প পারদর্শিতা। কথায় বলে প্যারিস অনেক গল্পকথার জন্ম দেয়। এভাবেই বোধহয় আরও একটি আন্তর্জাতিক গল্পের জন্ম হয়েছিল সকলের অজান্তে। উদয়শঙ্করের হাত ধরে জন্ম হয়েছিল পরবর্তীকালের কিংবদন্তি অমলাশঙ্করের…

পরবর্তীকালে ’৩১-এর সেই প্যারিস যাত্রার কথা যতবারই মনে করেছেন, ততবারই নানা আবেগ তাঁকে স্পর্শ করেছে। ঠিক যেমন মনে পড়বে রবিশঙ্করের সঙ্গে প্রথম আলাপের কথা। প্যারিসে প্রথমবার শঙ্কর পরিবারের বাড়িতে গেছেন অমলারা। রবিশঙ্কর তখন দশ বছরের বালক। পায়জামার ভেতর পাঞ্জাবিটা গুঁজে পরে ভলিবল খেলছেন। যেই অমলাকে দেখা, অমনি তড়িঘড়ি পাঞ্জাবিটা নামিয়ে নিলেন তিনি। তখন থেকেই বন্ধুত্ব। সেটাই ছিল আজীবন। ২০১২’র ১১ ডিসেম্বর মাস অবধি যে বন্ধুত্বে একচুলও ফাটল আসেনি।

ভারতের নাচের জগতে উদয়শঙ্কর-অমলাশঙ্কর এক কিংবদন্তি জুটি। দুজনের একের পর এক প্রযোজনা দর্শকদের মুগ্ধ করে রেখেছে আজও। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আহ্বানে ১৯৩৯ সালে অমলা যোগ দেন ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’-এ। একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া যেন সময়ের অপেক্ষা ছিল। ১৯৪২-এ অবশেষে চার হাত এক হল। উদয়শঙ্করের স্বপ্ন তখন আকাশছোঁয়া। নিজের প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে তাঁর অনেক ভাবনা, শিল্পকে নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা, পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে চান। সেই স্বপ্নের কারিগর হলেন অমলাশঙ্কর। 

স্বপ্নের তরীটি সোনালি সাগরে ভাসিল বটে; কিন্তু জল কি সব সময় শান্ত থাকে? জীবন যে বড়োই জটিল! সেখানে কখন যে ঝড় আসে, কখন যে বাড়ি ঘর ভেঙে উপড়ে যায় কেউ জানতেও পারে না। ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’-এ সেই সময়ের সেরা শিল্পীরা এসে যুক্ত হয়েছিলেন। আর ছাত্রছাত্রীরাও ছিলেন পরবর্তীকালের কিংবদন্তি। এখানেই উদয়শঙ্কর তৈরি করেন ছায়ানাটিকা ‘রামলীলা’। সবই চলছিল; এমন সময় হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল প্রতিষ্ঠানটি। উদয়শঙ্কর তখন ‘কল্পনা’ নিয়ে মশগুল। সংস্থাকে বাঁচানোর উদ্যোগ নেওয়া হল না সেভাবে। অমলাশঙ্কর পরে বলেছিলেন উদয়শঙ্করের জেদি ও অহং মানসিকতার কথা। অমলা অবশ্য প্রশাসনিক পদে কখনোই যুক্ত ছিলেন না। এতকিছুর পরেও উদয়-অমলার কাজ ‘কল্পনা’ মুক্তি পেল ১৯৪৮ সালে; যা ভারতীয় শিল্প জগতে অমর হয়ে থাকবে।

দুজনের মধ্যে মতানৈক্য ক্রমশ প্রবল হচ্ছিল, তা ভেতরে ভেতরে হয়ত দুজনেই বুঝতে পারছিলেন। ছেলে, মেয়ে, কাজ, সৃষ্টি— সব নিয়ে সুন্দর কাটছিল বটে; সেসবই বাইরের দৃশ্য। কিন্তু বাজ পড়তে দেরি হল না। ১৯৬৫-তে রবীন্দ্র সরোবরে উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার আবার নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করল। কিন্তু এবার কেন যে মন বসাতে পারছেন না উদয়শঙ্কর! তিনি ঠিক করলেন দল ঠিক করে দেশ বিদেশে ট্যুর করবেন। বাধা দিলেন অমলাশঙ্কর। এই প্রতিষ্ঠান তো নাচ শেখানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে। এরকম বাণিজ্যিক ট্যুরের জন্য তো নয়! শুনলেন না উদয়। এবার যে যে জায়গায় গেলেন, সব জায়গায় ব্রাত্য থাকলেন অমলা। এতদিন যে ঘটনা কখনও ঘটেনি। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ‘জেদি’ মানুষটা দমলেন না। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৩ সালে গলফ ক্লাবের নিজেদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন উদয়শঙ্কর।

ছেলে মেয়েদের নিয়ে তখনও একা লড়ে যাচ্ছেন অমলা। তবে শেষের দিনগুলোয় সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে যায়। ১৯৭৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, উদয়শঙ্করের চলে যাবার আগে হাসপাতালে যে কদিন ছিলেন, সেই কদিনই তাঁর পাশে ছিলেন অমলাশঙ্কর। মনে পড়েছিল ১৯৩১-এর কথা? আজ নিজেই সেই উত্তর দিয়ে গেলেন। সমস্ত নীরবতার অবসান নিজের হাতে করে দিয়ে গেলেন বাংলার অন্যতম শ্রদ্ধেয় এই ব্যক্তিত্ব। দুই প্রিয় মানুষের সঙ্গে আবারও হয়তো এক হওয়ার সুযোগ পাবেন তিনি… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More