পরোটার টানে রজতাভর ‘অন্তর্ধান’, মুখ গম্ভীর পরমব্রতর

“সেদিন শুটিং-এর সময় হঠাৎই বাধা পড়ল। রনিদাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছি। এমন সময় দেখা গেল রাস্তার ধারের একটি দোকানে বসে রনিদা আলুর পরোটা খাচ্ছেন।” বলছিলেন পরিচালক অরিন্দম ভট্টাচার্য। আগামীকালই রাজ্যের প্রেক্ষাগৃহগুলিতে মুক্তি পেতে চলেছে অরিন্দমের তৃতীয় সিনেমা ‘অন্তর্ধান’ (Antardhaan)। অবশ্য তার শুটিং থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ হয়ে গিয়েছে ২ বছর আগেই। সবাই মিলে হইহই করে হিমাচলপ্রদেশের (Himachalpradesh) বুকে শুটিং-এর সেই দিনগুলোর স্মৃতিও নতুন করে ফিরে ফিরে আসছে।

অরিন্দমের অভিযোগ শুনে বিব্রত রজতাভ দত্ত বললেন, “ভারতের উত্তর দিকে গেলে তো পরোটা খেতে মন হবেই। আর কশৌলির পরোটার স্বাদ সত্যিই অসাধারণ।” সত্যিই তো, আলুর পরোটা বা গোবি পরোটার ওপরে ঘি ছড়িয়ে দিলে যে গন্ধ বেরিয়ে আসে, সেটা একবার চেখে না দেখলে কি চলে? বাকিদেরও ধরে ধরে পরোটা খেতে ডাকতেন রজতাভ। তবে “পরম বা তনুশ্রী যেহেতু নায়ক-নায়িকার চরিত্রেই অভিনয় করে, ওদের তো খাওয়াদাওয়া নিয়ে অনেক বেশি পরিমিত থাকতে হয়। ইচ্ছে থাকলেও সবসময় আমার আবদার রাখতে পারেনি।” রজতাভ দত্তের কথায় খানিকটা অনুযোগের সুর। তবে পরোটা থেকে দূরে থাকলেও তনুশ্রী চক্রবর্তী খুঁজে এনেছিলেন একটি অসাধারণ বিস্কুট। সেই গল্পও বলতে ভুললেন না রজতাভ। মধু আর ড্রাইফ্রুট দিয়ে তৈরি সেই বিস্কুট কিনে কলকাতাতেও নিয়ে এসেছিলেন টিমের সকলে।

হিমাচলপ্রদেশে শুটিং-এর গল্প বলতে বলতে একটা কথা অবশ্য ঘুরেফিরে আসছিলই। পাহাড়ের ঠান্ডায় অভিনয়ের অভিজ্ঞতা সকলেরই কমবেশি আছে। কিন্তু হিমাচলপ্রদেশের ঠান্ডা সেই সমস্ত অভিজ্ঞতাকে হার মানায়। অরিন্দম জানালেন, সিনেমার একটি দৃশ্যে মমতা শঙ্করকে কাশতে দেখা যাবে। সেই শটটি নেওয়া গিয়েছে। তার পরেও তাঁর কাশি থামছে না। পরে জানা গেল, ঠান্ডায় সত্যিই গলা বসে গিয়েছে তাঁর। আর তাই কাশির অভিনয় করতে হয়নি, বরং সুযোগ পেয়ে সত্যিই কেশে নিয়েছেন তিনি। ইউনিটের সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেশ ঘুরেছেন মমতা শঙ্কর। তবে তিনিও কখনও এমন ঠান্ডার সামনে পড়েননি বলে জানালেন রজতাভ। প্রথম কয়েকদিন ঘরে রুমহিটার জ্বালিয়ে রেখেও ঠিকমতো ঘুম হয়নি কারোর। সকালে শুটিং-এর সময় সারা শরীরে ব্যথা থেকে যেত। “তবে অভিনেতাদের জীবনে তো এসব থাকেই। আমাদের রোদে পোড়া পিচের রাস্তায় জ্যাকেট পরে মারামারি করতে হয়, আর শীতের সময় খালি গায়ে গঙ্গার জলে নেমে যেতে হয়।” বলছিলেন রজতাভ। অরিন্দম বলছিলেন, “সবচেয়ে খারাপ লেগেছে মোহরের জন্য। বাকিরা তো প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত। কিন্তু ওর তো এটাই প্রথম সিনেমা।”

এভাবে একটি গোটা টিমকে নিয়ে পুরোপুরি বাইরে চলে গিয়ে অভিনয় খুব একটা সহজ কাজ নয়। তবে তার মধ্যে আনন্দ আর মজাও থাকে বিস্তর। রজতাভর কথায়, “এর ফলে একটা টিমের কেমিস্ট্রি গড়ে ওঠে। অভিনয়ের সময় এই সম্পর্কগুলো গড়ে ওঠা সিনেমার জন্যই খুব জরুরি।” আর তার সঙ্গে কশৌলির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো রয়েছেই। যদিও অরিন্দম জানালেন, তিনি বছর পাঁচেক আগী ‘অন্তর্লীন’ সিনেমার শুটিং-এর সময় যে দৃশ্য দেখে এসেছেন, তা এখন অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছে। তবে রজতাভ দত্ত সেই প্রথম কশৌলি গেলেন। তিনি প্রথম দেখার মুগ্ধতা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। প্রাকৃতিক শোভা তো রয়েছেই, সঙ্গে শহরের সাজসজ্জাও মুগ্ধ করার মতো। রজতাভ বলছিলেন, তাঁকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে দুটি বিষয়। প্রথমত, মূল বাজারের কাছে একটি স্টুডিও দেখে অবাক হয়েছেন তিনি। দেরাদুন, কশৌলি অঞ্চলে যে বহু কিংবদন্তি মানুষ থেকেছেন বা নানা সময়ে ঘুরতে এসেছেন, তাঁদের সকলের ছবি সাজিয়ে রাখা আছে সেই স্টুডিওতে। এভাবে শহরের ইতিহাসকে ধরে রাখার রেওয়াজ তো ধীরে ধীরে মুছেই যাচ্ছে। আর মুগ্ধ হয়েছেন শহরের নানা প্রান্তে ধ্যানচাঁদ এবং আরও ১১ জন পরমবীর চক্র প্রাপকের মূর্তি দেখে।

শুটিং-এর সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে ঘুরে বেড়ানোও। আর তারপর সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত সবাই মিলে চলত আড্ডা। কে কী দেখলেন, শোনাতেন বাকিদের। আড্ডা, মজা, ঘুরে বেড়ানো – এটুকুই অবশ্য সব নয়। কারণ মূল উদ্দেশ্য তো সিনেমাটাকে নিখুঁত করে তোলা। অরিন্দমের কথায় উঠে এল সেই অভিজ্ঞতার কথাও। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় নাকি রোজ শুটিং-এর সময় হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠতেন। কয়েকদিন তাঁকে দেখে বেশ চিন্তিতই হয়ে উঠেছিলেন অরিন্দম। সারারাত হাসিঠাট্টা করার পর হঠাৎ সকালে কী হল? তবে একদিন রজতাভ দত্তের প্রশ্নের উত্তরে পরমব্রত জানালেন, “আমি বাবা সাজার চেষ্টা করছি।” সিনেমায় যে মধ্যবয়স্ক সংসারী ব্যক্তির চরিত্রে তিনি অভিনয় করছেন, তাকে সম্পূর্ণ আত্মস্থ করার জন্যই গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।

এভাবেই একটু একটু করে পূর্ণতা পেয়েছে ‘অন্তর্ধান’। দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষে আগামীকাল সেই সিনেমা মুক্তিও পেতে চলেছে। কিন্তু সিনেমা তৈরির পিছনের এই গল্পগুলো না বলাই থেকে যেত হয়তো। কেবল কলাকুশলীদের স্মৃতিতেই বারবার ফিরে আসছে সেই দিনগুলো। না, কোনোকিছুই ব্যর্থ হয়নি। করোনা অতিমারী পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত দর্শকদের মুখ দেখতে চলেছে ‘অন্তর্ধান’।

Powered by Froala Editor