ব্রজবাসী রঘুনাথ দাস গোস্বামী একদা শ্রীরূপ গোস্বামীর রচিত ‘বিগগ্ধমাধব’ এবং ‘ললিতমাধব’ নাটকদুটি পড়ে দিব্য বিরহে অস্থির হয়ে পড়েন। তখন তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য শ্রীরূপ ‘দানকেলিকৌমুদী’ নামে লঘু হাস্যপরিহাসযুক্ত একটি নতুন নাটক রচনা করে তাঁকে শান্ত করেন। এই ‘দানকেলিকৌমুদী’ নাটকেই মিলবে রাইরাজার ইতিবৃত্ত। উক্ত নাটকে, শ্রীরাধার সখীদের মুখে তাঁর রাজ্যাভিষেকের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি সংক্ষেপে বলা যাক।
কৃষ্ণের আদেশ অনুসারে, আকাশবাণীর ছলনা করে একদা বৃন্দা ভগবতী পৌর্ণমাসীকে বলেছিলেন, “হে যোগেশ্বরী, আকাশবাণীর নির্দেশ অনুসারে এই বৃন্দাবন রাজ্যে শ্রীরাধার অভিষেক করুন।” সে কথা শুনে তিনি পাঁচজন দেবীকে আহ্বান করলেন। নন্দপুত্রী একানংশা, সূর্যপত্নী সংজ্ঞা ও ছায়া, সূর্যকন্যা যমুনা এবং মানসগঙ্গা— এই পাঁচজন দেবী উপস্থিত হলেন ব্রজধামে। বৃত্তান্ত শুনে ছায়া বললেন, মহীয়সী শ্রীরাধার পক্ষে ১৬ ক্রোশ বিস্তারিত বৃন্দাবন রাজ্য পরিমিত নয়, তাঁকে ব্রহ্মাণ্ডের আধিপত্যে অভিষিক্ত করাই সমীচীন। এ কথার উত্তরে একানংশা বললেন, বৈকুণ্ঠ অপেক্ষা মথুরার মাহাত্ম্য অধিক, আবার বৃন্দাবন মথুরা অপেক্ষাও অধিক গুণান্বিত। এই বৃন্দাবনের একাংশেই তো কোটি ব্রহ্মাণ্ডের আধিপত্য রয়েছে! একানংশার কথায় সকলে আনন্দিত হয়ে অভিষেকের আয়োজনে ব্যাপৃত হলেন।
যমুনা জানালেন, ব্রহ্মার কন্যা সরস্বতী ব্রজধামে অবতরণের জন্য পৌর্ণমাসীর আদেশের অপেক্ষায় আছেন। পৌর্ণমাসী আজ্ঞা দিলে, সরস্বতী আকাশপথে নেমে এলেন ব্রজে। সঙ্গে আনলেন ব্রহ্মাপত্নী সাবিত্রীর পাঠানো পদ্মমালা, ইন্দ্রপত্নী শচীর দেওয়া স্বর্ণ-সিংহাসন, কুবেরপত্নী ঋদ্ধির প্রেরিত রত্নালঙ্কার, বরুণপ্রিয়া গৌরীর উপহার ছত্র, পবনপত্নী শিবার প্রদত্ত চামরদ্বয়, অগ্নির ভার্যা স্বাহার দান বস্ত্রযুগল এবং যমপত্নী ধূমোর্ণার নিবেদিত মণিদর্পণ।
স্বর্গে আরম্ভ হল মঙ্গলবাদ্য, মেঘান্তরালে শুরু হল গন্ধর্বদের গান, অপ্সরারা মেতে উঠলেন নৃত্যচ্ছন্দে। দেবীরা সখীপরিবেষ্টিত শ্রীরাধাকে সিংহাসনে বসিয়ে রত্নকুম্ভ থেকে স্বর্গীয় মহৌষধি-রসামৃত বর্ষণের মাধ্যমে তাঁর রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন করলেন। শ্রীরাধা লাভ করলেন সমগ্র বৃন্দাবনের আধিপত্য। একানংশা কৃষ্ণবক্ষস্থিত কস্তুরী দ্বারা শ্রীরাধার কপালে তিলক অঙ্কন করলেন, ছায়া এবং সংজ্ঞা কেশসজ্জা করলেন, সখীরা পরালেন নানাবিধ অলঙ্কার। যমুনা চামর ব্যজন এবং সরস্বতী ছত্রধারণে প্রবৃত্ত হলেন। সখীগণ-সহ শ্রীরাধা বৃন্দাবনেশ্বরী রাজ্যশাসন আরম্ভ করলেন।
এই দিব্যলীলা অবলম্বনে ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে পদকর্তা মোহন রচনা করলেন—
‘একদিন সুন্দরি রাই সুনাগরি সব সহচরিগণ সঙ্গ।
শ্রীবৃন্দাবনে কুঞ্জনিকেতনে বৈঠল কৌতুকরঙ্গ।।
তঁহি পুন ভগবতি পৌর্ণমাসী দেবি ব্রজবনদেবিনি সাথ।
রাইক শুভ অভিষেক করণ লাগি আওল উলসিত গাত।।
কত শত ঘট ভরি বারি সুবাসিত তাহি করল উপনীত।
দধি ঘৃত গোরস কুঙ্কুম চন্দন কুসুম হার সুললীত।।
বাস ভূষণ উপহার রসায়ন আনল কত পরকার।
রতন বেদি পর বৈঠল শশিমুখি সখিগণ দেই জয়কার।।
শ্রীবৃন্দাবন ভূমীশ্বরী করি ভগবতি করু অভিষেক।
চৌদিকে জয় জয় মঙ্গল কলরব আনন্দে মোহন দেখ’।।’
নারায়ণ দাস, বংশীদাস প্রমুখ পদকর্তারাও উক্ত বিষয়ে পদ রচনা করেছেন। বংশীদাসের বর্ণনা— “কোটাল হইল শ্যাম মুরলীবদন। রাধিকা রাজার জয় দেয় ঘনেঘন।।” এই বিবরণ পরে বহু কবিতা, গীত, নাটক, চিত্রকলা এবং ভাস্কর্যের অনুপ্রেরণা হয়েছে। বাঙালির সংস্কৃতিতে চিরস্থায়ী ঔজ্জ্বল্য পেয়েছে রাইরাজার দরবার, যেখানে বৃন্দাদেবী অমাত্য, আর অসিচর্ম হাতে কোটাল স্বয়ং শ্যামসুন্দর।
শান্তিপুরের ভাঙা রাসের শোভাযাত্রায় আরাধ্য শ্রীবিগ্রহদের পাশাপাশি এক বিশেষ আকর্ষণ রাইরাজা। পূর্বে গোস্বামীদের গৃহ থেকে বিভিন্ন নিয়ম আচার মেনে, নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বংশের অরজস্বলা, সুন্দরী এবং সুলক্ষণা কিশোরীদের নির্বাচন করা হত, তাঁরাই বস্ত্রালঙ্কারে সেজে হাতির পিঠে রাইরাজা-রূপে শোভাযাত্রায় অংশ নিতেন। এখন নিয়ম কিছুটা শিথিল হয়েছে, বিভিন্ন গোষ্ঠীর তরফ থেকেই রাইরাজারা শোভাযাত্রায় অংশ নেন। সেইসঙ্গে, বিভিন্ন পার্বণে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে চলে রাইরাজার শ্রীমূর্তির সনিষ্ঠ সেবার্চনা।
Powered by Froala Editor