কথায় বলে ক্রিকেট এক বলের খেলা। কিন্তু এক বলও না খেলে মাঠ থেকে ফিরে যাওয়াটা দুভার্গ্যজনক তো বটেই। এক হতে পারে রান আউট হলে, আর যেভাবে হতে পারে সেটা দেখিয়ে দিয়েছে সাম্প্রতিক শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ ম্যাচ। এবারের ক্রিকেট বিশ্বকাপে পরের পর্বে যাওয়ার আর কোনো আশা নেই দু’দলের। সম্মানরক্ষার ম্যাচ হলেও এশিয়ার দুই দেশের খেলায় তো উত্তেজনা থাকবেই। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজের (Angelo Mathews) আউট নিয়ে যে বিতর্কটা তৈরি হল, সেটা ছিল একেবারেই হিসেবের বাইরে।
২৫তম ওভারে শ্রীলঙ্কার রান তখন ১৩৫। সমরাবিক্রমা ফিরে যাওয়ার পর ব্যাট করতে নামার কথা অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজের। কিন্তু হেলমেটের স্ট্র্যাপের গণ্ডগোলে মাঠে ঢুকতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে যায় তাঁর। এদিকে ক্রিকেটের নিয়ম অনুযায়ী নতুন ব্যাটার নামার জন্য বরাদ্দ সময়সীমা দু’মিনিট। অর্থাৎ, ওই সময়ের মধ্যে ব্যাটার মাঠে প্রবেশ না করলে তাঁকে ‘টাইমড আউট’ ঘোষণা করা যেতে পারে। সেই নিয়ম মেনে আবেদন জানান বাংলাদেশের অধিনায়ক শাকিব আল হাসান (Shakib Al Hasan)। ব্যাস, কোনো বল না খেলেই ফিরে যেতে হয় অ্যাঞ্জেলোকে। ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য ঢুকে পড়ল ‘টাইমড আউট’-এর ঘটনা। যদিও, এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে বিতর্ক। খাতায়-কলমে যাই থাক, খেলোয়াড়ি স্পিরিটের সঙ্গে কি আদৌ সাযুজ্যপূর্ণ এই কাজ? অনেকে অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন মানকড় আউটের কথা। কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্যাটার অতিরিক্ত সুবিধা পান, ‘টাইমড আউট’-এর বেলা সেই যুক্তি খাটে না।
সে যাই হোক না কেন, ক্রিকেটে অদ্ভুত আউটের সংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়। নিয়ামক সংস্থার খাতা উলটে-পালটে দেখলে জানা যায় মোট এগারো রকম আউটের কথা বলা আছে সেখানে। এর মধ্যে বোল্ড, ক্যাচ, এলবিডব্লু (লেগ বিফোর উইকেট), রান আউট, স্ট্যাম্প, হিট উইকেট মতো ঘটনা তো প্রায়শই শোনা যায়। এছাড়াও আছে কিছু বিশেষ নিয়ম। খুব কম প্রয়োগ হলেও আইনের খাতায় কিন্তু দিব্যি জ্বলজ্বল করছে তাঁরা।
শুরু করা যাক ‘অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ড’ দিয়ে। অর্থাৎ সম্ভাব্য আউটের হাত থেকে বাঁচার জন্য বলের গতিপথ বা বিপক্ষের খেলোয়াড়ের কাজে অন্যায়ভাবে বাধা সৃষ্টি করা। এই নিয়মে আউট হওয়া একটি আশ্চর্য ঘটনা কিন্তু ভারতবাসীদের পক্ষে ভোলা মুশকিল। পাকিস্তানের বিধ্বংসী ব্যাটার ইনজামাম উল হকের সেই বিখ্যাত আউট! ২০০৬ সালের কথা। পেশোয়ারে চলছে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজনা যথেষ্ট। পাকিস্তানের জিততে প্রয়োজন ৪১ বলে ৪০ রান। মাঠে রয়েছেন ইনজামাম আর ইউনিস খান। শ্রীসন্থের বলে ইনজামাম আস্তে করে ঠেলে দিলেন মিড অফে। রান নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তিনি ক্রিজের থেকে কিছুটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে সুরেশ রায়না বলটি ছুঁড়ে দিলেন উইকেটের দিকে। বাইরে দাঁড়িয়েই খেলার ভঙ্গিতে ব্যাট দিয়ে বল নামিয়ে দিলেন মাটিতে। আম্পায়াররা কিছুক্ষণ আলোচনা করে জানালেন ইনজামাম আউট। কারণ, বলটি উইকেটে লাগলে ছিল রান আউটের সম্ভাবনা। অবশ্য তিনি পরে স্বীকার করেছিলেন যে, এই নিয়মের বিষয়ে ধারণা ছিল না তাঁর। আশ্চর্যের বিষয় হল, ‘অবস্ট্রাক্টিং দ্য ফিল্ড’-এ আউট হওয়া ক্রিকেটারদের মধ্যে পাকিস্তানিদের সংখ্যাই বেশি।
আরও পড়ুন
পুরুষ নয়, প্রথম চালু হয়েছিল মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ
এবার আসা যাক আইনের ৩৩তম ধারা অনুযায়ী ‘হ্যান্ডল দ্য বল’-এর কথায়। ফিল্ডিং দলের অনুমতি ছাড়া বল ধরতে পারবেন না কোনো ব্যাটার। তাহলে তাঁকে আউট দেওয়ার আবেদন জানাতে পারে বিপক্ষ। যদিও উলটো ঘটনাটাই বেশি ঘটতে দেখা যায়। দিব্যি বল কুড়িয়ে বোলার বা ফিল্ডারের দিকে ছুঁড়ে দেন সেই ব্যাটার। আসলে এসব ক্ষেত্রে বল হয় ‘ডেড’ হয়ে যায় কিংবা অন্যভাবে আউটের সম্ভাবনা থাকে না। তাই আর আবেদন জানানোর প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু এভাবে বলের গতিপথ রুদ্ধ করে বা দিক পরিবর্তন করে আউট হয়েছেন বেশ কয়েকজন। যার মধ্যে আছেন স্টিভ ওয়া, মাইকেল ভন, গ্রাহাম গুচ, মহিন্দর অমরনাথের মতো খেলোয়াড়। মনে পড়তে পারে ১৯৯৩ সালের অ্যাসেজের কথা। ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন-আপকে একাই টানছেন গুচ। নিয়ে যাচ্ছেন অন্তত সম্মানজনক ‘ড্র’-এর দিকে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মার্ভ হিউজেসের একটা বাউন্সার সমস্ত চিত্র বদলে দিল। বলটি ঠেকাতে পারলেও, তা চলে যাচ্ছিল স্ট্যাম্পের দিকে। আউট নিশ্চিত ভেবে হাত দিয়ে বল সরিয়ে দেন গুচ। ব্যাস, আউট! পরের দিনের সংবাদপত্রে ছাপা হল ‘অস্ট্রেলিয়াকে অ্যাশেজ দিয়ে দিলেন গুচ’।
আরও পড়ুন
নিশীথ সূর্যের দেশে ক্রিকেট
ক্রিকেটে আউটের আরেকটি নিয়ম হল ‘হিট দ্য বল টোয়াইস’। অর্থাৎ, শরীর বা ব্যাট দিয়ে একাধিকবার আঘাত করা যাবে না বলকে। অবশ্য এক্ষেত্রে দ্বিতীয় আঘাতটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে হবে। নতুবা তো দু’বার ব্যাটে লেগে যেতেই পারে। ঘরোয়া ক্রিকেটে এরকম আউটের ঘটনা ঘটলেও আন্তর্জাতিক খেলায় কিন্তু এর উদাহরণ চোখে পড়ে না।
খুব অচেনা না হলেও রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে আউটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু আকর্ষণীয় গল্প। যেমন ১৯৭২ সালে অস্ট্রেলিয়ার শেফিল্ড শিল্ডে ম্যাচে গ্রেম ওয়াটসনের আউট। নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে তিনি তখন করে ফেলেছেন ১৪৫ রান। একটা বল ব্যাটের কোণায় লেগে চলে যায় গালির ফিল্ডারের হাতে। আউট ভেবে প্যাভিলিয়নের পথে পা বাড়ান ওয়াটসন। কিন্তু পরে জানতে পারেন বলটি আগেই মাটি ছুঁয়েছিল। পরে আম্পায়ারকে জিজ্ঞেস করায় হাসির রোল ওঠে সর্বত্র। কারণ, আম্পায়ার ভেবেছিলেন চোট পেয়ে রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে ফিরে গেছেন ওয়াটসন। আবার এক দুঃখজনক ঘটনাও জড়িয়ে এই আউটের সঙ্গে। ১৯৮৩ সালে গর্ডন গ্রিনিচ ব্যাট করাকালীন জানতে পারেন মেয়ের অসুস্থতার কথা। সঙ্গে সঙ্গে রিটায়ার্ড আউট নিয়ে ছুটে যান হাসপাতালে। দুদিন পরে মারা যায় তাঁর মেয়ে। তখন তাঁকে ঘোষণা করা হয় ‘রিটায়ার্ড নট আউট’ হিসেবে।
ফলে আউট নিয়ে বিতর্ক বা আশ্চর্য সব গল্প জড়িয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরেই। এবারের বিশ্বকাপও বাদ রইল না সেই বিতর্ক থেকে। তবে ‘টাইমড আউট’-এর গল্পের প্রসঙ্গে ভারতের নাম উঠতে বাধ্য। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক গ্রেম স্মিথের ‘স্পিরিট’-এর জন্য সেবার বেঁচে গেছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। ২০০৭ সালে টেস্ট ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে দ্রুত দুই উইকেট হারিয়ে ফেলে ভারত। চার নম্বরে নামার কথা শচিন তেন্ডুলকরের। কিন্তু ফিল্ডিংয়ের সময় বিরতি নেওয়ায়, এখন তিনি মাঠে নামতে পারবেন না। ভিভিএস লক্ষণ স্নানে। শেষে নামতে হল সৌরভকে। কিন্তু প্রস্তুত হতে লেগে গেছিল প্রায় ছ’মিনিট। সেদিন কিন্তু গ্রেম স্মিথ চাইলেই ‘টাইমড আউট’ করতে পারতেন সৌরভকে। করেননি তিনি। মাঠে অপেক্ষা করে অটুট রেখেছিলেন ‘ভদ্রলোকের খেলা’-র সমস্ত গরিমা।
Powered by Froala Editor