“There are more things in heaven and earth, Horatio,
Than are dreamt of in your philosophy.”
সত্যিই, আমাদের চারিপাশে এমন কত কিছু ঘটে যায় যা আমাদের ভাবনারও অতীত। সামান্য এই জীবনের পক্ষে সেসব নাগালে পাওয়া কঠিন। শুধু বর্তমান নয়, আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকালেও কত রহস্যময় ঘটনা জড়িয়ে আছে। কিছুর ব্যাখ্যা আছে; আবার কিছু জিনিসের ব্যাখ্যা এসেছে অনেক পরে। যতক্ষণ না সব বুঝে ফেলা হচ্ছে, ততক্ষণ অবাক হয়ে দেখে চলা সেই কাণ্ডকারখানা। এই জীবন যেন অদ্ভুত একটি সার্কাস!
এত গৌরচন্দ্রিকা করার কারণ, আজকের রঙ্গমঞ্চটিও একটি সার্কাস। সেখানে মানুষ তো বটেই, খেলা দেখাচ্ছে পাখি, হাতি, ঘোড়া, বাঘ-সিংহরাও। হঠাৎই সেই ভিড় থেকে বেরিয়ে এল একজন। মানুষই বটে, কিন্তু চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে না! ঘন সোনালি চুলে ঢেকে আছে সর্বাঙ্গ। ঠিক যেন মানুষরূপী এক সিংহ! নৃসিংহ অবতারের মতো। একটা সময় এই চেহারাই ভয় দেখালেও, পরে এটাই হয়ে যায় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। স্টিফেন বিব্রোস্কি ওরফে ‘লিওনেল দ্য লায়ন ম্যান’-এর জীবনটাই বদলে দেয় সার্কাসের মঞ্চ। তাঁর দুঃখ হতাশা ঢেকে দেয় চড়া আলো। সত্যিই কি ঢাকতে পেরেছিল?
সার্কাস মানে এখন জিমনাস্টিক, কিছু পশু-পাখি আর জোকারদের সমাবেশ। তবে উনবিংশ-বিংশ শতকে সার্কাসের ব্যাপ্তি আরও বিশাল ছিল। সেখানে পশু-পাখি, খেলা ছাড়াও থাকত কিছু অদ্ভুত মানুষ। অদ্ভুত বলতে, তাঁদের শারীরিক কিছু অস্বাভাবিকত্ব। বিজ্ঞানে সন্ধান করলে যার ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু সমাজের চোখে তাঁরা ‘অদ্ভুত’ই। এরমই এক অদ্ভুত মানুষ ছিলেন স্টিফেন বিব্রোস্কি। ১৮৯০ সালে পোল্যান্ডে জন্মেছিলেন তিনি আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর মতোই। তেমনই চলত বাকিটা, কিন্তু দেখা দিল সমস্যা। যত সময় এগোতে থাকে, স্টিফেনের শরীর ঢেকে যেতে থাকে ঘন লোমে। সবাই ঘাবড়ে যায় তাঁকে দেখে। মা-বাবার দিক থেকেও তৈরি হয় জটিলতা। স্টিফেনের বাবাকে নাকি একসময় একটি সিংহ আক্রমণ করে। কোনোক্রমে তিনি বেঁচে যান। তবে স্টিফেনের মায়ের বক্তব্য ছিল, বাবা বেঁচে গেলেও, সেই অভিশাপ প্রবাহিত হয়েছে তাঁদের সন্তানের মধ্যে। তাই এরকম ‘কুৎসিত ও ভয়ংকর’ হয়ে জন্মেছেন তিনি।
আরও পড়ুন
মার্কিন নাগরিকত্ব পাওয়া প্রথম ভারতীয় তিনি, আমৃত্যু কাটিয়েছেন সেখানেই
স্টিফেনের যখন চার বছর বয়স, তখন তাঁর অভিভাবকেরা একটি জার্মান সার্কাসে তাঁকে বিক্রি করে দেন। সেই থেকে শুরু সংগ্রাম। এই সংগ্রাম শুধু টিকে থাকার নয়; নিজের সঙ্গেই নিজের লড়াই করার। তখন থেকেই শুরু খেলা দেখানোর। তখন থেকেই স্টিফেন বিব্রোস্কি বদলে যান ‘লিওনেল দ্য লায়ন ম্যান’ হিসেবে। প্রাথমিক ভয় ও বিস্ময় কাটিয়ে ওঠার পর তিনি হয়ে ওঠেন স্টার। শুধু তাঁকে দেখার জন্যই ভিড় জমত সার্কাসে।
আরও পড়ুন
তিনটে পা ও ১৬টি আঙুল নিয়েই আমেরিকা মাতিয়েছেন ফ্র্যাঙ্ক, শিখেছেন ফুটবলও
এইসব কিছু আরও বেড়ে গেল ১৯০১ সালে। স্টিফেন চলে যান আমেরিকায়। সেখানকার বিখ্যাত বারনাম অ্যান্ড বেইলি সার্কাসে যুক্ত হন তিনি। তখন হাতের তালু আর পায়ের পাতা বাদ দিয়ে তাঁর গোটা শরীরই ঢেকে আছে ঘন সোনালি লোমে। বারনাম অ্যান্ড বেইলিতে আসার পর দেখলেন, সেখানে তাঁর মতো আরও বেশ কিছু ‘অদ্ভুত’ মানুষ আছেন। সবাই মিলে খেলা দেখাতে শুরু করলেন। অল্প কয়েকদিনেই সবার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন তিনি। তাঁর নম্র স্বভাব, বিনয় মুগ্ধ করে সবাইকে।
বিংশ শতাব্দীর কুড়ির দশকের শেষের দিকে সার্কাস ছাড়েন স্টিফেন বিব্রোস্কি। আর তাঁর কয়েক বছর পরেই, ১৯৩২ সালে বার্লিনে মাত্র ৪১ বছর বয়সে মারা যান ‘লায়ন ম্যান’। জীবনে আর কোনোদিনও নিজের মা-বাবার দেখা পাননি। চেনা মানুষদের থেকে হারিয়ে চলে গিয়েছিলেন দূরে। জগতজোড়া নাম হলেও, কোথাও কি একা ছিলেন না স্টিফেন বিব্রোস্কির মতো মানুষরা? আজ আমরা জানি হাইপারট্রাইকোসিসের কথা। ঠিক এই রোগটাই ছিল স্টিফেনের। তিনি ভিনগ্রহের জীব ছিলেন না। তাঁর মতো আরও যারা সার্কাসে ঠাই পেয়েছিলেন, তাঁরা সাধারণ মানুষই ছিলেন। কিন্তু আমরা, সভ্য মানুষরা তাঁদের এক কোণে ঠেলে দিয়েছি। সার্কাসের দর্শনীয় বস্তু করেছি। সেই দুঃখেই স্টিফেন বিব্রোস্কিরা শেষ হয়ে গেছেন আস্তে আস্তে।
Powered by Froala Editor