প্রকাশকের অপছন্দ, নেহাত ভুলে যেতেই ‘স্পাইডার-ম্যান’ লিখেছিলেন স্ট্যান লি!

কয়েকদিন আগের কথা। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল স্পাইডার-ম্যানের সিরিজের সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র ‘নো ওয়ে হোম’। ইতিমধ্যেই গোটা বিনোদনজগতে সাড়া ফেলে দিয়েছে এই সিনেমা। জনস্রোতে উপচে উঠছে প্রেক্ষাগৃহগুলি। সুপারহিরো চলচ্চিত্রের জগতে এই সিনেমা এক নতুন মাইলস্টোনই বটে। কিন্তু জন্মলগ্নেই হারিয়ে যেতে বসেছিল এমন একটি জনপ্রিয় সুপারহিরো চরিত্র। কারণ, স্পাইডার-ম্যানের (Spider-Man) গল্পকে প্রথমেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন জনপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদক।  

হ্যাঁ, প্রথম কাজেই ব্যর্থমনোরথ হয়েই ফিরতে হয়েছে স্পাইডি-স্রষ্টা স্ট্যান লি-কে (Stan Lee)। শুধু স্পাইডার-ম্যানই নয়, আয়রন ম্যান, হাল্ক, থর, ব্ল্যাক প্যান্থার, এক্স-মেন সিরিজের মতো চরিত্রদেরও জন্মদাতা তিনি। কিন্তু কেন প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছিল স্ট্যান লি-কে? সেই গল্পই বলা যাক শুরু থেকে। 

সেটা তিরিশের দশকের একদম শেষ লগ্ন। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে হবে। স্ট্যান লি’র বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর। দু’চোখে একদিন বড়ো ঔপন্যাসিক হওয়ায় স্বপ্ন। অথচ, সেসব আর হওয়া হল না। আর্থিক অনটনের সঙ্গে  দৈনন্দিন মোলাকাত তাঁর পরিবারের। হাইস্কুলের গণ্ডি পেরনোর পরেই সংসারের ভার চাপল কাঁধে। চাকরিও জুটে গেল টাইমলি পত্রিকার কমিক্স বিভাগে। 

তবে খুব একটা সহজ ছিল না সেই চাকরি টিকিয়ে রাখার কাজ। মার্কিন মুলুকে তখন রাজত্ব ডিসি কমিক্সের। বাজার কাঁপাচ্ছে ব্যাটম্যান, সুপারম্যানের মতো সুপারহিরোরা। তার কাছে টাইমলি নিতান্তই শিশু। এমন একটা পরিস্থিতিতে বাড়তি চ্যালেঞ্জ এসে পড়ল সতেরো বছরের কিশোরের কাঁধে। নতুন সুপারহিরো চরিত্র তৈরি করতে হবে তাঁকে। 

আরও পড়ুন
প্রথম ভারতীয় হিসাবে কমিক জগতের ‘অস্কার’জয়ী আনন্দ

কোনো চলতি কমিক্সের পর্ব লেখার কাজ নয়। খোদ নতুন সুপারহিরো তৈরি। চ্যালেঞ্জিং বললেও হয়তো কম বলা হয় ব্যাপারটাকে। কী কী অতিমানবিক ক্ষমতা দেওয়া যায় তাঁকে? তাঁর নামই বা কী হবে? অফিসের কেবিনে বসে এসবই ভাবছিলেন স্ট্যান লি। এমন সময়ে তাঁর চোখ পড়ে দেওয়ালের দিকে। নিজের খেয়ালে রেশমের জাল বুনে চলেছে একটি মাকড়সা। সেই দৃশ্য থেকেই যেন গল্পের প্লট খুঁজে পেলেন স্ট্যান লি। চরিত্রের নামটাও স্পষ্ট ফুটে উঠল মাথার মধ্যে। স্পাইডার-ম্যান!

আরও পড়ুন
কমিক্সের বই থেকে সোশ্যাল মিডিয়া; নতুন প্রজন্মের হাত ধরে মিমের জগতেও উজ্জ্বল টিনটিন

শোরের কল্পনা যেমন হয়, নিজের মধ্যেই যেন স্পাইডার-ম্যানকে খুঁজেছিলেন স্ট্যান লি। হ্যাঁ, একজন কিশোরের মধ্যেই সুপারহিরোর চরিত্রাঙ্কন করলেন স্ট্যান। পিটার পার্কার— সেই কমিক্সের সুপারহিরো একজন স্কুলের ছাত্র। স্ট্যানের মতো তার জীবনও নানান সমস্যায় জর্জরিত। গোটা গল্পটা ফেঁদে ফেলার পর সম্পাদকের কাছে জমা দিলেন গল্পের নীল-নকশা। অবশ্য তার আগেই সহকর্মী তথা বন্ধু স্টিভ ডিটকোকে দিয়ে ছবিও আঁকিয়ে ফেললেন স্ট্যান। কিন্তু কেই বা তখন জানত, পত্রপাঠ বাতিল হয়ে যাবে এই সুপারহিরোর পরিকল্পনা!

আরও পড়ুন
নিজের হাতেই এঁকেছিলেন অ্যাসটেরিক্সকে, চলে গেলেন কমিকসটির স্রষ্টা অ্যালবার্ট ইউদেরজো

‘স্পাইডার-ম্যান’ নামটি নিয়েই প্রথম আপত্তি তুললেন সম্পাদক। মাকড়সা দেখলে গা শিরশির করে ওঠে, এমন লোকের সংখ্যা প্রচুর। ভয়ের থেকেও বড়ো কথা, আটপেয়ে এই জীবটিকে মানুষ দেখে ঘেন্নার চোখে। সেখানে দাঁড়িয়ে স্পাইডার-ম্যানের কমিক্স ডাহা ফেল করবে এমনটাই যুক্তি দিলেন সম্পাদক। তার ওপর এই চরিত্র আবার টিনেজার। তার ব্যক্তিগত জীবনেও এত সমস্যা। এসব নিয়ে কি সুপারহিরো হওয়া যায়? খানিক বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন স্ট্যান। টাইমলিতে ছাড়পত্র পেল না স্পাইডার-ম্যান। কিন্তু স্পাইডার-ম্যানের ভূত নামল না স্ট্যানলির ঘাড় থেকে। 

স্ট্যান লি সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রকাশিত হোক ছাই না হোক এই কমিক্স তৈরি তিনি করবেনই। উৎসাহী বন্ধু ডিটকোও সঙ্গ দিলেন তাঁর। শেষ পর্যন্ত, পত্রিকার এক বাতিল হয়ে যাওয়া সংখ্যার শেষে কোনোক্রম গুঁজে দেওয়া গেল স্পাইডিকে। নেহাত মাকড়সা-ভূত মাথা থেকে নামাতেই এই লেখা, প্রথম ও শেষ। আর সেখানেই যেন ম্যাজিক খেলে গেল। এক কথায় গোটা মার্কিন মুলুক যেন গোগ্রাসে গিলল স্পাইডার-ম্যানের কমিক্স। আর সেই সম্পাদক? হ্যাঁ, গল্প হিট করার পরে স্ট্যানের কাছে ছুটে এসেছিলেন তিনি। দাবি, এই চরিত্র নিয়ে সিরিজ নামাতে হবে তাঁকে। 

না, তাঁকে ফেরাননি স্ট্যান। পরবর্তীতে মারভেল কমিক্সের অন্যতম চরিত্র হয়ে ওঠে পিটার পার্কার-খ্যাত স্পাইডার-ম্যান। তারপর সিনেমা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, এই বিশেষ চরিত্রটির জন্য টাইমলির থেকে কোনোরকম রয়্যালটিই পাননি তিনি। কেননা, তিনি তখন অস্থায়ী কর্মী ছিলেন টাইমলি পত্রিকার। 

২০১৫ সালে এই বিবিসি রেডিও ৪-এর এক সাক্ষাৎকারে কৈশোরের এই ঘটনা সামনে আনেন স্ট্যান লি। স্ট্যানের নিজের জীবনের এই গল্প, লড়াই, জয় রূপকথার থেকেই বা কম কি? সাধারণ মানুষ হয়েও যে সুপারহিরো হওয়া যায় তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ তিনি স্বয়ং নিজেই…

Powered by Froala Editor

More From Author See More