সাল ১৯১২, দিনটি ছিল ১৫ এপ্রিল। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে ভেসে আছে একটি বিশাল ‘দৈত্য’। স্থির, যেন অপেক্ষা করছে কারোর জন্য। আর দৈত্যের পেটের ভেতর ছোটাছুটি করছে অসংখ্য মানুষ। খানিক আগেই এক ভাসমান হিমবাহের সঙ্গে যুদ্ধ হয়ে গেছে লোহার দৈত্যের। তারপর যে কী হল, ক্রমশ সমুদ্রের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে লাগল সে। তৈরি হল ‘টাইটানিক’ নামক একটি মিথের, একটি চিরকালীন ব্যর্থ স্বপ্নের। জেমস ক্যামেরনের হাত ধরে জাহাজের ডেকে হাজির হল জ্যাক আর রোজ। কিন্তু ক্যামেরন কি জানতেন ১৮৮৮ সালের নভেম্বর মাসে ঘটা একটি বিশেষ ঘটনার কথা? টাইটানিকের ডুবে যাওয়ার ২৪ বছর আগে, ভারতের বুকেও জন্ম নিয়েছিল আরও একটা ‘টাইটানিক’। এই গল্প আরও একটি কিংবদন্তির। এই গল্প এসএস বৈতারণা-র…
তখন সিপাহী বিদ্রোহের রেশ কমেছে। দেশের প্রতিটি কোণায় নিজেদের আধিপত্য চড়িয়ে দিচ্ছে ব্রিটিশরা। সেইসঙ্গে বাড়ছে তাঁদের বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য। সেই সময়ই ১৮৮৫ সালে গ্রেঞ্জমাউথ ডকইয়ার্ড কোং লিমিটেড তৈরি করে তাঁদের অদ্ভুত সৃষ্টি— এসএস বৈতারণা। ১৭০ ফুট লম্বা লোহার দৈত্যটি এসে হাজির হয় মুম্বাইতে। টাইটানিকের মতো অমন বিত্তবান অন্দরমহল না হলেও, সেই সময়ের হিসেবে যথেষ্ট জোগাড়যন্ত্র করা হয়েছিল। প্রধানত কচ্ছের মাণ্ডভি বন্দর থেকে মুম্বই পর্যন্ত যাত্রী আর মালপত্র নিয়ে যেত জাহাজটি। কাজেই অতটা বিলাসবহুল দৃষ্টি দিয়ে দেখাও হয়নি জাহাজটিকে। কিন্তু ধারে-ভারে একে ‘গুজরাটের টাইটানিক’ বলাই যায়!
১৮৮৮ সালের ৮ নভেম্বর সেরকমই একটি যাত্রায় বেরিয়েছিল এসএস বৈতারণা। ঠিক কতজন যাত্রী ছিলেন ওই সময়, তার সঠিক তথ্য জানা যায় না। তবে মনে করা হয়, সংখ্যাটি প্রায় হাজারের কাছাকাছিই হবে। মাণ্ডভি থেকে মুম্বইয়ের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ই যাত্রা শুরু করেছিল জাহাজটি। ক্যাপ্টেন হিসেবে ছিলেন দাহিসারের জমিদার কাসাম ইব্রাহিম ওরফে হাজি কাসাম। ঠিক ছিল, দ্বারকা পৌঁছনোর পর পোড়বন্দর হয়ে মুম্বইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে এসএস বৈতারণা। কিন্তু আরব সাগরের আবহাওয়া ক্রমশ উত্তাল হতে শুরু করেছিল। কাজেই ঠিক করা হল, পোড়বন্দর আর নয়। মুম্বইয়ের উদ্দেশ্যেই সোজা রওনা দেবে জাহাজটি। পোড়বন্দরে যারা অপেক্ষায় ছিলেন, তাঁরা হতাশই হলেন প্রাথমিকভাবে। তারপরই অপেক্ষা করছিল চমক…
১৮৮৮-এর ৮ নভেম্বরের রাতেই আরব সাগরে নেমে এল প্রবল ঝড়। সমুদ্র আরও বেশি উত্তাল হল। ঢেউয়ের ঝাপটায় কেউই দাঁড়াতে পারবে না সেখানে। সেই মুহূর্তে সাগরের বুকেই ভেসে বেড়াচ্ছিল এসএস বৈতারণা। হাজি কাসাম-সহ অন্যান্য যাত্রীরাও ছিলেন। সেই শেষবার। পরেরদিন থেকে জাহাজটির কোনো খোঁজই পাওয়া গেল না! বেশ কয়েকজন পড়ুয়া মুম্বাইতে পরীক্ষার দেওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন এই জাহাজে। তাঁরা তো বটেই, বাকি যাত্রীদেরও কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।
একপ্রকার নিখোঁজই হয়ে গেল এসএস বৈতারণা। ওই ঝড়েই হয়ত পথ হারিয়ে অন্য দিকে চলে যায়; অথবা সলিলসমাধি হয় তার। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, জাহাজের কোনো ভগ্নাবশেষ বা যাত্রীদের দেহও পাওয়া যায়নি। সমুদ্রের নিচেও খোঁজা হয়েছিল— সব বৃথা। তবে তদন্তে উঠে আসে বেশ কিছু তথ্য। বলা হয়, এসএস বৈতারণার সুরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট ছিল না। জাহাজের ভেতর যথেষ্ট পরিমাণে লাইফবোট ও লাইফ জ্যাকেট ছিল না। বিশাল চেহারার হলেও বড়ো ঝড় সহ্য করার শক্তি তার কতটা ছিল, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কিন্তু তখন আর কিছুই করার ছিল না। এসএস বৈতারণা তখন নিরুদ্দেশ যাত্রায়…
তারপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। ধীরে ধীরে জাহাজটির কথা দেশ ভুলেই গেছে। টাইটানিককে গোটা বিশ্ব মনে রেখেছে; অথচ ২৪ বছর আগের এমনই একটি ঘটনা বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেল। পুরোপুরি গেছে কি? আজও গুজরাটের উপকূলবর্তী অঞ্চলে মানুষরা একটি লোকগান গেয়ে বেড়ান। তাঁদের ‘বিজলি’-র চলে যাওয়ার স্মৃতিতেই বারবার বেজে ওঠে সেই সুর। উঠে আসেন হাজি কাসাম। রাতের অন্ধকারে আরব সাগরের ধারে যখন সেই সুর বেজে ওঠে, তখন কোথাও গিয়ে মিশে যায় উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর আর ভারত। মিশে যায় দুটো জাহাজ। ঘনিয়ে ওঠে স্মৃতি, দুঃখ…
আরও পড়ুন
৩১০ বছর আগে ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে উদ্ধার কোটি কোটি টাকার ধনসম্পত্তি
তথ্যসূত্র-
১) ‘Disaster at Sea: SS Vaitarna- India’s Forgotten ‘Titanic’’, Akshay Chavan, Live History India
২) ‘20 Years before Titanic tragedy, India’s own Titanic sank near Gujarat, 1000 people drowned’, Maninder Dabas, India Times
আরও পড়ুন
সমুদ্রের নিচে ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে উঠে এল কঙ্কাল, অবস্থা থেকে চমক গবেষকদের
Powered by Froala Editor