বিগত কয়েকদিন ধরেই ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছিল শ্রীলঙ্কা (Sri Lanka)। রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে প্রতিবাদে সামিল হচ্ছিলেন অসংখ্য মানুষ। দাবি উঠেছিল, পদত্যাগ করতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। শনিবার বেলা গড়াতেই অগ্নিগর্ভ রূপ নিল পরিস্থিতি। জলকামান, টিয়ার গ্যাস, রবার বুলেট, গুলি— সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করেই রাষ্ট্রপতিভবনে ঢুকে পড়লেন বিক্ষোভকারীরা। দখল নিলেন গোটা প্রাসাদের। অন্যদিকে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন রাষ্ট্রপতি (President) গোতাবায়া রাজাপক্ষে (Gotabaya Rajapaksa)।
গতকাল রাত থেকেই রাষ্ট্রপতিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছিল শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী। তবে তার আগেই ভয়াবহ রূপ নেয় পরিস্থিতি। শ্রীলঙ্কার সচিব গামিনী সেনারথের বক্তব্য অনুযায়ী, শনিবার সকাল ১০টা নাগাদ সরকারী বাসভবন ছাড়তে বাধ্য হন রাষ্ট্রপতি। তার ঘণ্টা খানেক পরেই, অনুপ্রবেশকারীরা ব্যারিকেড ভেঙে প্রবেশ করেন প্রাসাদে, দখল নেন রাজভবনের। কিন্তু কেন এই অভ্যুত্থান?
বিগত কয়েক মাস ধরেই ক্রমশ সংকট বাড়ছিল খাদ্য, ওষুধ এবং জ্বালানির। ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি তার অন্যতম কারণ। মুদ্রাস্ফীতির মাত্রা পৌঁছায় প্রায় ৭০ শতাংশে। যা শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে এই প্রথমবার। স্বাধীনতার পর এই চরমতম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ই গণঅভ্যুত্থানকে প্ররোচিত করেছে তাতে সন্দেহ নেই কোনো। আর এই ঘটনার জেরেই জনগণের রোষের মুখে পড়েন রাষ্ট্রপতি।
আশ্চর্যের বিষয় হল, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ— দক্ষিণ এশিয়ার এই তিনটি দেশের থেকেই অর্থনীতির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল শ্রীলঙ্কা। দ্বীপরাষ্ট্রটির মাথাপিছু গড় আয় ছিল প্রায় ৪ হাজার মার্কিন ডলার। এমনকি ২০১৯ সালে, শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৭.৬ বিলিয়ন ডলার। জনসংখ্যা, ক্ষেত্রফল ও প্রাকৃতিক সম্পদের নিরিখে বিচার করলে, তা ভারতের বৈদেশিক রিজার্ভের থেকেও যথেষ্ট বেশি। কিন্তু তারপরেও কেন এত দ্রুত পতন হল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির?
অনুৎপাদনশীলতা এবং ব্যয়বহুল পরিকাঠামোকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। সেইসঙ্গে ঋণের বোঝা আরও কোণঠাসা করেছে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটিকে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে ওঠে যে, বাসিন্দাদের জ্বালানী বাঁচাতে ১০ জুলাই পর্যন্ত বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেন খোদ রাষ্ট্রপতি। শ্রীলঙ্কান সমালোচক ওমালপে সোবিথার কথায়, এই সংকট দুর্ভিক্ষ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলাফল নয়, বরং প্রশাসনের ভুল মাশুল দিতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে।
স্বাভাবিকভাবেই তাই ভিলেন হয়ে উঠেছিল গোটা রাজাপক্ষ পরিবার। হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুধু গোতাবায়াই নন, তাঁর পরিবারের একাধিক সদস্যই রয়েছেন সে-দেশের সংসদের উচ্চপদে। এমনকি তাঁর ভাই মহিন্দ রাজাপক্ষ কিছুদিন আগে পর্যন্তও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শ্রীলঙ্কার। দাবি উঠেছিল, রাজনীতির মঞ্চ থেকে সরতে হবে রাজাপক্ষদের। অথচ, এই রাজাপক্ষরাই ছিলেন একসময় শ্রীলঙ্কার বীর নায়ক।
২০০৭ সালের কথা। তখন রাষ্ট্রপতির আসনে ছিলেন মহিন্দ রাজাপক্ষ। অন্যদিকে গোতাবায়া ছিলেন দেশের প্রতিরক্ষা সচিব। শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণের নেপথ্যে ছিলেন তাঁরাই। ২০০৭-২০০৯— দু’বছরের অভিযানে লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলমের অবসান ঘটিয়েছিলেন রাজাপক্ষ ভাতৃদ্বয়। নিহত হয়েছিলেন টাইগার-নেতা প্রভাকরণ। ফলে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে ব্যাপকভাবে সমর্থন পেয়েছিলেন গোতাবায়া। যুদ্ধনায়কের আসনে বসিয়েছিল তাঁকে গোটা দেশ।
তবে এর পর থেকেই সামনে আসতে থাকে একের পর এক অভিযোগ। তাঁর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলা জারি হয় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং শ্রীলঙ্কায়। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় মুসলিম বিরোধী দাঙ্গাতেও পূর্ণ মদত ছিল রাজাপক্ষদের— উঠেছিল এই অভিযোগ। সর্বোপরি চিনের ‘হোয়াইট এলিফ্যান্ট’ নীতিতে স্বাক্ষর করে ঋণের বোঝায় ডুবে যাওয়াই কাল হয়ে দাঁড়ায় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের। দেশের শিল্পীমহল থেকে শুরু করে ধর্মীয় নেতা, ছাত্রছাত্রী, নাগরিক-অধিকারকর্মী— প্রায় সকলেই শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন তাঁর।
সপ্তাহ খানেক আগে বিদ্রোহ দমন করতে কলম্বোর আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি ও ক্ষমতাসীন সরকার। বিক্ষোভকারীদের যাতে রাষ্ট্রপতি ভবনের নিকটবর্তী হতে না দেওয়া হয়, সেই আবেদনই করেছিলেন রাজাপক্ষরা। তবে শ্রীলঙ্কার আদালত খারিজ করে দেয় সেই অনুরোধ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কারফিউ-এর পথে হেঁটেছিল শ্রীলঙ্কা সরকার। বার অ্যাসোসিয়েশন থেকে শুরু করে বিরোধী দল— প্রায় সকলেই ‘অনৈতিক’ তকমা দিয়েছিলেন এই লকডাউনকে। তবে লাভ হল না তাতেও। শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের রোষে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন গোতাবায়া। তবে বর্তমানে কোথায় রয়েছেন তিনি, তার খবর মেলেনি এখনও। কী হবে এই ঘটনার পরিণতি, তাও অনিশ্চিত। এই অভ্যুত্থানে শ্রীলঙ্কার ভাগ্যবদল হবে কিনা, সেই উত্তর দেবে সময়ই…
Powered by Froala Editor