দু’সপ্তাহ জ্বলার পর ডুবল রাসায়নিক কার্গো জাহাজ, বিপর্যয়ের মুখে শ্রীলঙ্কা

সমুদ্রের জলে ভাসছে মরা মাছ আর কচ্ছপের মৃতদেহ। বদলে গেছে জলের রংও। পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে বলেই অভিমত বিশেষজ্ঞদের। এখন শুধু বিপর্যয়ের প্রহর গুনছে শ্রীলঙ্কা।

দু’সপ্তাহ আগেই সূত্রপাত হয়েছিল ঘটনার। শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরের কাছেই হঠাৎ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয় সিঙ্গাপুরের কার্গো এমভি এক্স-প্রেস পার্ল। তবে দু’সপ্তাহ পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও, রক্ষা পেল না প্রকৃতি। যা আশঙ্কা ছিল, হলও তেমনটাই। এবার জাহাজের একাংশ ভেঙে ডুবে গেল সমুদ্রে।

কিন্তু এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ কী? কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, ১৪৮৬টি কন্টেনার নিয়ে যাচ্ছিল জাহাজটি। যার মধ্যে ছিল ২৫ টন নাইট্রিক অ্যাসিড। নাইট্রিক অ্যাসিডের কন্টেনার থেকেই গত ২০ মে অগ্নিসংযোগ হয় জাহাজে। তারপরই বিস্ফোরণ। তবে শুধু নাইট্রিক অ্যাসিডই নয়, তাছাড়াও একাধিক ক্ষতিকর রাসায়নিক, প্রসাধনী দ্রব্য এবং প্লাস্টিকের বিভিন্ন সামগ্রী বোঝাই ছিল এমভি এক্স-প্রেস পার্লে। বিস্ফোরণের পর যা ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্রে। সেইসঙ্গে অগ্নিকাণ্ডে প্লাস্টিকজাত সামগ্রী গলে, দূষণ ছড়িয়েছে সমুদ্রে। 

নেগম্বো এবং কলম্বো— নিকটবর্তী এই দুই শহরের উপকূলই সম্প্রতি ছেয়ে গেছে ছোটো ছোটো প্লাস্টিকের প্যালেটে। সমুদ্রতট থেকে উদ্ধার হয়েছে কয়েক টন গলে যাওয়া প্লাস্টিক ও পলিব্যাগের কাঁচামাল। তবে পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, এর বাইরেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অংশ এখনও মিশে রয়েছে সমুদ্রে। সমুদ্রস্রোতের মাধ্যমে বাহিত হয়ে তা পৌঁছাতে পারে ভারত, ইন্দোনেশিয়া এমনকি জাপানেও। 

আরও পড়ুন
বছরের পর বছর বিপর্যয় ‘টিকিয়ে রাখা’র শিকার সুন্দরবন?

আগুন নেভার পরই জাহাজটি উদ্ধারের কাজে হাত লাগিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার বন্দর কর্তৃপক্ষ। সাহায্যের জন্য ঘটনাস্থলে পৌঁছায় একটি ভারতীয় রণতরীও। উপকূল থেকে জাহাজটিকে দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছিল এক নাগাড়ে। তবে সম্প্রতি ব্যর্থ হয় সেই প্রচেষ্টা। মাঝ বরাবর ভেঙে যায় কার্গো জাহাজটি। বর্তমানে একাংশ ভেসে থাকলেও, আরেক অংশ স্পর্শ করেছে সমুদ্রের তলদেশে। যার গভীরতা অন্ততপক্ষে ২১ মিটার। এই অবস্থায় আর জাহাজটিকে সরানো সম্ভব নয় বলেই জানাচ্ছে শ্রীলঙ্কার বন্দর কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুন
মহারাষ্ট্রে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে মৃত ৫২, নতুন বিপর্যয়ের ইঙ্গিত?

তবে আরও বড়ো বিপর্যয় হয়তো অপেক্ষা করে আছে শ্রীলঙ্কার জন্য। জাহাজটির বাঙ্কারে মোট ২৭৮ টন জ্বালানি তেল-সহ, মজুত ছিল ৫০ টন প্রাকৃতিক গ্যাস ও ২০ টন লুব্রিকেটিং ওয়েল। সেই তেল জাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়লে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে। মাত্রাতিরিক্ত দূষণ ছড়িয়ে পড়বে উপকূলবর্তী গ্রামগুলিতেও। এমনটাই আশঙ্কা করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। তবে শ্রীলঙ্কার অভিমত, আগুনে ইতিমধ্যেই পুড়ে গেছে জাহাজের জ্বালানি। তা সত্ত্বেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে সমুদ্র প্রতিরক্ষা দলকে।

আরও পড়ুন
বিপর্যয়ের এক মাস আগে থেকেই শুরু হয়েছিল ধ্বংসযজ্ঞ, উত্তরাখণ্ডের ছবি প্রকাশ করল নাসা

ইতিমধ্যেই গোটা বিষয়টি নিয়ে শুরু হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত। পুরো তদন্তের নিরিখে আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের দাবিও জানিয়েছে শ্রীলঙ্কা। অন্যদিকে নাইট্রিক অ্যাসিড লিক হওয়ার ঘটনা স্বীকার করে নিয়েছে সিঙ্গাপুরের জাহাজ কর্তৃপক্ষ। বিগত ১১ মে তারিখেই নাবিকদের থেকে লিক হওয়ার ঘটনাটি জানতে পারে বলে জানাচ্ছে তারা। সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির সাফাই, ভারত এবং কাতার তাদের বন্দরে দাঁড়ানোর সুযোগ না দেওয়ায় আরও দক্ষিণে শ্রীলঙ্কার দিকে অগ্রসর হয়েছিল জাহাজটি। আর সেখানেই থেকে যাচ্ছে প্রশ্ন। ১৫ মে ভারতের গুজরাট বন্দরে হল্টের পর যাত্রা শুরু করেছিল জাহাজটি। লিকের কথা জানা সত্ত্বেও কেন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হল না তখন, উঠছে প্রশ্ন । 

অন্যদিকে বিপর্যয়ের কারণে সমুদ্রে মৎস্যশিকারেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে শ্রীলঙ্কার প্রশাসন। যার ফলে উপার্জনের পথ বন্ধ হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার পরিবারের। সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর এই অগ্নিকাণ্ডে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা। এই অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে ঠিক কতদিন সময় লাগবে— সে ব্যাপারে আলোকপাত করতে ব্যর্থ বিশেষজ্ঞরাও…

Powered by Froala Editor