সমাধান করেছেন তিনশোরও বেশি কেস, কেনিয়ার ‘স্পাই কুইন’ জেন মুগো-র গল্প

থমথমে বাড়ির নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎই বেজে উঠল কলিং বেল। অর্থাৎ ক্লাইম্যাক্স উপস্থিত। দরজার ঠিক পাশেই দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন তিনি। সতর্ক করে দিলেন বাকি এজেন্টদেরও। এই মুহূর্তে সামান্যতম ভুল প্রাণঘাতী হতে পারে। এক বৃদ্ধ ব্যক্তি টাকাভর্তি সুটকেস হাতে নিয়ে খুলে দিলেন দরজার। সুটকেসের বদলে দুই দুষ্কৃতি ফিরিয়ে দিল মুখ বাঁধা একটি ছোট্ট শিশুকে। এবার তাদের ফেরার পালা। মোক্ষম মুহূর্তে ঝলসে উঠলে এবার তিনি। দেয়ালের আড়াল থেকে বেরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই অপরাধীর ওপরে। তাইকন্ডুর প্যাঁচে তার হাতে ধরা রিভালবার ছিটকে গেছে দূরে। আর অন্যজন কিছু বোঝার আগেই বুলেটে ধরাশায়ী হয়েছে তার হাঁটু।

কী মনে হচ্ছে? কোনো হলিউড সিনেমা? না, একেবারেই তেমনটা নয়। এই গল্প বাস্তবের এক গোয়েন্দার। জেন মুগো— কেনিয়ার এই মহিলা বেসরকারি গোয়েন্দা পরিচিত ‘স্পাই কুইন’ নামেই। বলা যায়, তিনি আফ্রিকার এই দেশের জেমস বন্ডের মহিলা সংস্করণ। হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ কিংবা স্রেফ জীবনসঙ্গীর ওপরে সন্দেহ— কেনিয়ায় রহস্য সমাধানের অন্যতম ভরসা তিনি। এমনকি রাজনীতিবিদ এবং সরকারের হয়েও একাধিক মামলার নিষ্পত্তির দায়িত্বও এসেছে তাঁর কাছে। 

এখনও পর্যন্ত তিনশোর বেশি কেসের নিষ্পত্তি করেছেন মুগো। যার কিছু কেনিয়ায়, আবার কিছু কেনিয়ার বাইরেও, বিদেশে। কারাগারে পাঠিয়েছেন কেনিয়ার প্রায় ৭০ জন কুখ্যাত দুষ্কৃতিকে। এককথায় বলা যায়, রহস্যোন্মোচনের ক্ষেত্রে তিনি অপরাজেয়। 

আফ্রিকার এই দেশে গোপনে দারুণভাবে সক্রিয় অন্ধকার জগৎ। খুন, জখম, অপহরণ সেখানে দৈনন্দিনের ব্যাপার। তবে সরকারি পুলিশের ওপর ভরসা নেই সাধারণ মানুষের। আর সেই কারণেই কেনিয়ায় রমরমা বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থাদের। বিশ্লেষকদের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর কেনিয়ায় কয়েক কোটি মার্কিন ডলার খরচ হয় বেসরকারি এই গোয়েন্দা খাতে। তবে কেনিয়ায় অন্যদের থেকে সফলতায় বহুগুণে এগিয়ে জেন মুগো।

কিরিনয়াগার ক্যারোটি গার্লস হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই হেড গার্ল ছিলেন মুগো। ছোট থেকেই নির্ভীক তিনি। সওয়াল ন্যায়-বিচারের পক্ষে। পেশার ক্ষেত্রেও তারপর বেছে নিলেন এই পথই। স্নাতকতা করেছেন কেনিয়াট্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিমিনোলজি নিয়ে। তারপর সোজা প্রবেশ অপরাধজগতের রহস্য সমাধানে।

জনপ্রিয় এই ডিটেক্টিভও হয়েছেন একাধিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। কেনিয়ার সন্ত্রাসবাদীদের তালিকাতেও ২০১৮ সালে উপস্থিত হয়েছিল তাঁর নাম। অভিযোগ ছিল হত্যার হুমকির দিয়েছেন এই প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। তবে তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন মুগো। এমনকি পরের বছর হাজির হন আদালতেও। সেখানে অবশ্য রায় গিয়েছিল তাঁর পক্ষেই। কোনো প্রমাণই দিতে পারেনি পুলিশ-প্রশাসন। 

আরও পড়ুন
তিন-তিনটি দেশে গুপ্তচরবৃত্তি, ডাসকো পোপভের অনুকরণেই জন্ম 'জেমস বন্ড'-এর!

তবে একদিকে যেমন তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, তেমনই অভাব নেই শত্রুরও। গোয়েন্দার ওপরেই চলে ক্রমাগত গোয়েন্দাগিরি। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, কেনিয়ার বেশিরভাগ দুষ্কৃতিই হত্যা করতে চায় তাঁকে। সেই কারণে নিজের নিরাপত্তার কথাও ভাবতে হয় মুগোকে। বাড়িতে প্রায় সব জায়গাতেই তিনি লাগিয়ে রেখেছেন গোপন ক্যামেরা। রয়েছে ১০ জন স্পেশাল এজেন্ট। যাঁরা বিভিন্ন অভিযানে মুগোর সঙ্গ দেন তো বটেই, সেইসঙ্গে বাড়ির নিরাপত্তার জন্যও সর্বদা প্রস্তুত। প্রতিদিনই চলে কঠিন অনুশীলন, প্রশিক্ষণ। এমনকি খাবার খাওয়ার আগে তা নিজের রাঁধুনিকে সামনে বসিয়ে খাওয়ান মুগো। বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা একেবারে মুছে যাওয়ার পরই মুখে দেন সেই খাবার। তাঁর সন্তানকেও মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল একবার।

কিন্তু এসবের পরেও অবিচল কেনিয়ার ‘স্পাই কুইন’। অপরাধীদের সাজা দেওয়াই তাঁর নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। হয়ে গেছে দৈনন্দিন জীবনের অংশ। যতদিন প্রাণ রয়েছে, ঝুঁকি নিয়েই অপরাধী শিকারের কাজ চালিয়ে যাবেন মুগো। বন্ডের মতোই হারতে জানেন না তিনিও।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ট্রাক ড্রাইভার, শ্রমিক থেকে পর্দার ‘জেমস বন্ড’; শন কনেরি ও এক অতিমানবিক আখ্যান