বিতর্ক-সংশয়ের মধ্যেই ‘স্পুটনিক ভি’ ব্যবহারে অনুমোদন ভারতের

২০২০ সালের আগস্ট মাস। গোটা বিশ্বকে আকস্মিকভাবেই চমকে দিয়েছিল রাশিয়া। ভ্যাকসিন তৈরিতে সাফল্যের কথা ঘোষণা করেছিল ক্রেমলিন। দেওয়া হয় স্থানীয়ভাবে এই টিকা ব্যবহারের লাইসেন্সও। স্পুটনিক ভি। শুরুর দিন থেকেই এই রাশিয়ান টিকা নিয়ে অবকাশ নেই বিতর্কের কিংবা সংশয়ের। আর এসবের মধ্যেই এবার এই টিকার অনুমোদন দিল ভারত সরকার। আগামী মে মাসের পয়লা তারিখ থেকেই প্রদান করা হবে স্পুটনিক ভি।

বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে ৬০টির বেশি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে স্পুটনিক। সেই তালিকায় এবার যুক্ত হল ভারতের নামও। তবে এতকিছুর পরেও বৈশ্বিক অনুমোদন পায়নি স্পুটনিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মার্কিন এফডিএ কিংবা ইউরোপিয়ান মেডিক্যাল এজেন্সি এখনও পর্যন্ত গররাজি এই টিকাকে সবুজ সংকেত দিতে। তবুও বাড়তে থাকা চাহিদার জেরেই আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ বড়োসড়ো জায়গা করে নিয়েছে আরডিআইএফ-এর এই টিকাটি। কিন্তু কেন এমন প্রতিক্রিয়া স্পুটনিকের ব্যাপারে?

অধিকাংশ স্বাস্থ্য সংস্থাগুলিই বলছে, রাশিয়া স্পুটনিকের সাফল্য দাবি করলেও বেশ কিছু ফাঁক রয়ে গেছে তার স্বচ্ছতায়। প্রকাশ করা হয়নি গবেষণার সামগ্রিক তথ্য। পাশাপাশি এই ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগও হয়েছিল অত্যন্ত অল্প কিছু মানুষের ওপরে। ফলত, অ্যাস্ট্রোজেনেকা বা অন্যান্য ভ্যাকসিনগুলির মতো বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিন পরীক্ষা করা হয়নি। সেই সঙ্গে টিকা তৈরি ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির দিকে তথ্য-হ্যাকিং-এর অভিযোগ তুলেছিল ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মতো দেশ।

তবে এসবের মধ্যেই ভারতের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, ছ’ দফায় রপ্তানি হবে স্পুটনিকের। তার মধ্যে ৪ দফায় রাশিয়া এই ভ্যাকসিন পাঠাবে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই। বাকি দু’ দফার ভ্যাকসিন তৈরি হবে ভারতে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রোগ্রামের অংশ হিসাবে। আর ভারতের বাজার দখল করতে ৮৫ কোটি ডোজের গণ-উৎপাদনের পথেই হাঁটছে রাশিয়া। 

আরও পড়ুন
‘আমরা খেতে পেলে কোভিড-আক্রান্তরাও খেতে পাবেন’; লড়ছে বাঙালির রান্নাঘরও

রাশিয়ায় এই ভ্যাকসিন মূলত তৈরি হয়েছে দুটি অ্যাডিনোভাইরাসের ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ সাধারণ ফ্লুয়ের ভাইরাসের সঙ্গে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের সংমিশ্রণে তৈরি এই ভ্যাকসিন। তবে বিশেষত্ব, টিকার দুটি ডোজের মধ্যে এখানে রয়েছে সামান্য রাসায়নিক তারতম্য। যদিও, রাশিয়ার দাবি এই ফারাকই বাকি ভ্যাকসিনদের তুলনায় কার্যকর করে তুলেছে স্পুটনিককে। 

আরও পড়ুন
কোভিড-মোকাবিলায় ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার, যোগাযোগ বুনছে বাংলার তরুণ প্রজন্ম

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনেকার কোভিশিল্ডও তৈরি এই একই প্রযুক্তিতে। তবে সেখানে ব্যবহৃত অ্যাডিনোভাইরাস মূলত শিম্পাঞ্জির কমন কোল্ড ভাইরাস। অন্যদিকে কোভ্যাকসিনে ব্যবহৃত হয়েছে নিষ্ক্রিয় মৃত করোনাভাইরাস। যা মানবদেহে সংক্রমণ না করলেও, অ্যান্টিবডি তৈরির কাজ করতে পারে অনায়াসেই। গঠনমূলক তারতম্য এইটুকুই। অন্যদিকে আরডিআইএফের দাবি, ৯১ শতাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিরক্ষা তৈরিতে সক্ষম হয়েছে স্পুটনিক।

আরও পড়ুন
কোভিড-পরস্থিতি মোকাবিলায় হেল্পডেস্ক প্রেসিডেন্সির পড়ুয়াদের

আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ডোজের জন্য এই টিকার দাম ধার্য করা হয়েছিল ১০ ডলার। অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় তা ৭৫০ টাকার মধ্যে। তবে দেশ বিশেষে সেই দামের তারতম্য লক্ষ করা গিয়েছিল। ভারতের বাজারে এই টিকার দাম ঠিক কত হবে, সে বিষয়ে এখনও কোনো সঠিক তথ্য দিয়ে উঠতে পারেনি সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি। হিটরো বায়োফর্মা, গ্ল্যান্ড ফার্মা, স্টেলিস বায়োফর্মা, পানাসিয়া বায়োটেক, ভার্চো বায়োটেক এবং মেডিকেয়ার— স্পুটনিকের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এই ছয় ভারতীয় সংস্থা। ফলত, দুই দেশের সম্মিলিত প্রয়াসে খানিকটা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে টিকার মূল্য। তা সত্ত্বেও কোভ্যাকসিন বা কোভিশিল্ডের থেকে বেশি টাকা দিয়েই স্পুটনিক কিনতে হবে মানুষকে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। 

গবেষকরা জানাচ্ছেন, ২১ দিনের মধ্যে নিতে হবে এই ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ। তার তিন সপ্তাহের মধ্যেই দেহে গড়ে উঠবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। কোভিশিল্ড ও কোভ্যাকসিনের পাশাপাশি স্পুটনিকের ব্যবহার ভারতে খানিকটা হলেও গতি আনবে গণ-টিকাকরণে। তাতে সামগ্রিকভাবে উপকৃত হবে সাধারণ মানুষ। তা সত্ত্বেও বেশ ভালোই সময় লাগবে গোটা দেশের ভ্যাকসিনেশনে। ততদিন মহামারীকে আটকে রাখতে পারবে তো ভারতের নাজেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা? সেই প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে বার বার…

Powered by Froala Editor