কিছুদিন আগেও বিভিন্ন গ্রাম্য মেলায় দেখা যেত তাদের। ভিড় জমতো হাজার হাজার মানুষের। কোথাও দুটাকা, কোথাও পাঁচ টাকা টিকিট কেটে মানুষ তাদের দেখতে যেত। না, কোনো চিড়িয়াখানায় জন্তু নয় তারা। জলজ্যান্ত দুজন মানুষ। বসিরহাটের এক হতদরিদ্র কৃষকের দুই মেয়ে গঙ্গা এবং যমুনা। শুনে অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন মানুষ দেখতে এমন ভিড় কেন? কারণ এঁরা খানিক ব্যতিক্রমী। এমন শারীরিক গঠন লাখে একটাও মেলে না। দুই বোনের শরীর একসঙ্গে যুক্ত। কোমরের উপরে দিব্যি স্বাভাবিক দুই মানুষ। ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড সবই আলাদা। কিন্তু কোমরের নিচ থেকে একটাই শরীর। দুজনের দুটি মাত্র কিডনি; হাঁটার জন্য পা দুটো, আর একটা অকেজো পা। এমন বিরল দর্শন মানুষ দেখতেই তাই ভিড় জমে উঠতো মেলায়। এমন কথাও শোনা যেত, "কলকাতার চিড়িয়াখানাতেও তো এমন দেখা যায় না।"
১৯৬৯ বা ৭০ সালে বসিরহাটে জন্ম গঙ্গা মণ্ডল এবং যমুনা মণ্ডলের। জন্মের সময়েই দেখা যায়, দুই যমজ সন্তানের কোমরের নিচের দিকে একসঙ্গে জোড়া। তখন এদেশে কন্যাসন্তান হত্যার ঘটনা আখছার ঘটতো। গঙ্গা-যমুনার বেলাতেও তেমনটা হতে পারত। কিন্তু ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস! বেঁচে থেকেও সারা জীবন বিদ্রুপ আর ব্যাঙ্গের মধ্যে কাটাতে হল দুই বোনকে। তাদের দেখে উৎসাহী জনতা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠত। তবে এর মধ্যে অনেকে তাঁদের ভয়ও পেত। কেউ ভাবত তাঁরা ডাইনি, কেউ ভাবত কোনো দেবী। কুসংস্কারের বসে মানুষের মনে এমন কত ধারণার উদ্ভব ঘটে। এই কারণেই তো তাদের জন্মের পরেও মেরে ফেলা হয়নি তাঁদের। ভয় যে তাঁদের বাবা-মায়ের মনেও ছিল!
এভাবেই দিন চলছিল কোনোরকমে। প্রদর্শনীর জন্য মাঝে মাঝে বাইরেও যেতে হত। তবে শহরে প্রদর্শনীর টিকিটের দাম থাকতো বেশি। এর মধ্যেই ধীরে ধীরে কাটে শৈশব-কৈশোর। যৌবনে পা দেয় দুই বোন। তাদের জীবনেও প্রেম এসেছিল, সবার যেমন আসে। দুই বোন ভালোও বেসেছিলেন একজন মানুষকেই। সেই মানুষটিও ভালোবেসেছিলেন দুজনকে। সেই লোকটির নাম গদাধর। একদিন গদাধর তাঁদের বিয়ে করতে চাইলেন। কিন্তু দুই বোনের সঙ্গে একটি পুরুষের বিয়ে! শুরুতেই এসে পড়ল আইনি জটিলতা। অবশ্য আদালতের অনুমতি নিয়ে শেষ পর্যন্ত বিবাহ হল। সন্তানসম্ভবা হলেন দুই বোন। তবে দীর্ঘ চেষ্টার পরেও সেই সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তাররা। এমনকি, ভবিষ্যতে প্রসবের সময় দুই বোনের জীবন সংশয় দেখা দিতে পরে মনে করে তাদের ওভারি দুটো কেটে বাদ দিয়ে দেন ডাক্তাররা।
তবে এখনও গুছিয়ে সংসার করেন গঙ্গা-যমুনা, আর গদাধর। দুই বোন একে অন্যের চুল আঁচড়ে দেন, সাজিয়ে দেন। আজকের বিচ্ছিন্নতার অসুখে জর্জরিত এই পৃথিবীতে এভাবেই একসঙ্গে আছেন দুই বোন। অনেকে তাঁদের গঠনের জন্য বলে, ‘স্পাইডার সিস্টার’। কিন্তু ওঁরাও মানুষ। শুধু মানুষের যোগ্য মর্যাদা সেভাবে পাননি কোনোদিন।
আরও পড়ুন
'কালাজাদু' তথা গুপ্তবিদ্যায় দক্ষ ছিলেন বাঙালি মেয়েরাও? ইতিহাস জানান দেয় সে-কথাই
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বাঙালিদের মধ্যে প্রথম মহিলা মার্শাল আর্ট ট্রেনার, মেয়েদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন সুতপা পাত্র