“সরকারের মাথায় রাখা দরকার, বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষ আছেন। সেটা দৃষ্টিহীন হতে পারে, চলচ্ছক্তিহীন হতে পারে, ডাউন সিনড্রোম হতে পারে, আরও অনেক কিছু… পাড়ায় পাড়ায় ক্লাস হলে এই সকল প্রতিবন্ধী শিশুরা কীভাবে ক্লাস করবে, সে-ব্যাপারে কোনো নির্দেশিকা কিন্তু দেওয়া হয়নি।”
বলছিলেন বিক্রমগড় হাইস্কুলের দৃষ্টিহীন শিক্ষক সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়। কোভিড পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল স্কুলের পঠনপাঠন। অবশেষে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আজ থেকে খুলে গেল স্কুলের গেট। আর শিশুরা? হ্যাঁ, তারাও স্কুলে ফিরল বটে। তবে চার দেওয়ালের গণ্ডির মধ্যে হচ্ছে না সেই ক্লাস। খোলা আকাশের তলায়, শ্রেণিকক্ষের বাইরে ক্লাস করতে হচ্ছে প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রদের। সরকারের এই ‘পাড়ায় পাঠশালা’ প্রকল্পের প্রসঙ্গেই কথা বলছিলেন সায়ন্তনবাবু।
বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যে-সমস্ত স্পেশাল স্কুল রয়েছে, সেগুলি মূলত জনশিক্ষা প্রসার বা সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বিভাগের আওতায় পড়ে। কোভিড পরিস্থিতিতে এই দপ্তরের থেকে বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কোনো গাইডলাইন সরবরাহ করা হয়নি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। তারপরই এমন একটি আকস্মিক বদলের সঙ্গে কতটা মানিয়ে নিতে পারবে বিশেষ শিশুরা, থেকে যাচ্ছে সন্দেহ। “বিগত দু’বছর ধরে স্পেশাল থেরাপি সেন্টারগুলি বন্ধ থাকায়, অটেস্টিক বাচ্চারা অনেক বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এ তো মানসিক প্রতিবন্ধীদের কথা গেল। এছাড়াও যাদের লোকোমোটিভ, দৃষ্টি বা শ্রবণেন্দ্রিয়ের সমস্যা আছে— খোলা মাঠে তাদের পক্ষেও ক্লাস করাটা যথেষ্ট সমস্যাদায়ক”, জানালেন অমৃতা মুখোপাধ্যায়। যিনি শুধুমাত্র স্কুল শিক্ষিকাই নয়, একজন বিশেষভাবে সক্ষম শিশুর অভিভাবকও।
সাধারণত, বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আলাদা রিসোর্স রুমের বন্দোবস্ত থাকে স্পেশাল স্কুলে। পাশাপাশি তাদের জন্য স্পেশাল টিচার বা এডুকেটর নিয়োগ করা হয়। এতদিন পর্যন্ত স্কুল বন্ধ থাকায় সে-সব সুবিধা থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবেই বঞ্চিত হয়েছে প্রতিবন্ধী পড়ুয়ারা। ক্লাস চালু হওয়ায় কি সেই সমস্যার সমাধান হচ্ছে আদৌ? “পাড়ায় পাড়ায় এই যে পাঠশালার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে কি স্পেশাল ক্লাসের সুবিধা তারা পাবে? প্রতিবন্ধী শিক্ষকরাই বা ক্লাস করাবেন কীভাবে?” প্রশ্ন তুললেন সায়ন্তনবাবু। হ্যাঁ, এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট গাইডলাইনই পাঠানো হয়নি শিক্ষকদের। সবটাই ধোঁয়াশা-ঘেরা।
আরও পড়ুন
বন্ধ স্কুল, থেমে নেই প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস, নেপথ্যে বাখরাহাটের শিক্ষক
পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখতে গেলে, ভারতে প্রতি ৬০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন অটিস্টিক শিশু। তাছাড়া অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা মিলিয়ে ৭.৬২ শতাংশ শিশু বিশেষভাবে সক্ষম। তাদের জন্য কোনো পূর্বপরিকল্পনা এবং গাইডলাইন ছাড়াই এমন একটি প্রকল্প ঘোষণা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে থেকে যাচ্ছে সন্দেহ। বলার অপেক্ষা থাকে না, সার্বিকভাবেই যেন অবহেলিত হচ্ছে বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্র-ছাত্রীরা।
আরও পড়ুন
বায়ুদূষণ প্রতিকারে পথ দেখাচ্ছেন মুম্বাইয়ের স্কুলছুট প্রযুক্তিবিদ
আরও বেশি করে সমস্যার সম্মুখীন হবেন প্রতিবন্ধী শিক্ষক-শিক্ষিকারা। বিশেষত যাঁরা পঞ্চম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নেন। সায়ন্তনবাবুর কথায়, “সপ্তম শ্রেণির পরেই যদি আমার অষ্টম শ্রেণির ক্লাস থাকে, তবে কি পাড়ার পাঠশালা থেকে আবার স্কুলে আসতে হবে আমাকে?” সেক্ষেত্রে তাঁদের যাতায়াতের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে কোনোরকম যানবাহনের ব্যবস্থা থাকবে কিনা, সে-ব্যাপারেও কিছু জানায়নি সরকার। সেইসঙ্গে বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্রছাত্রীদের নানাভাবে বুঝিয়ে ক্লাসে রাখতে হয়, খোলা জায়গায় ক্লাস হলে আদৌ তাদের পড়াশোনায় মন বসবে কিনা, থেকে যাচ্ছে সন্দেহ”, যোগ করলেন সায়ন্তনবাবু। ফলে আক্ষরিক অর্থেই এই ধরনের প্রকল্প প্রতিবন্ধী শিক্ষকদের জন্য সম্ভবপর নয়, তা একপ্রকার স্পষ্ট।
আরও পড়ুন
কলমকারি শিল্পকে বাঁচাতে স্কুল পড়ুয়াদের উদ্যোগ
অন্যদিকে ত্রিপল টাঙিয়ে খোলা আকাশের নিচে ক্লাস হলেও, চড়া রোদ কিংবা শীতের হাওয়ার দাপট তো রয়েছেই। সেইসঙ্গে রয়েছে আরও একাধিক প্রতিবন্ধকতা। ‘পাড়ায় পাঠশালা’-র ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের জন্য শৌচালয় ও পানীয় জলের বন্দোবস্ত করার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে আদৌ কি সম্ভব হঠাৎ করে পানীয় জলের পরিকাঠামো তৈরি করা? শহরের ক্ষেত্রে পানীয় জল ও শৌচালয়ের সমস্যা না থাকলেও, ঘন জনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে দূরত্ব বিধি মেনে একত্রে কয়েকশো ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস করানোর জায়গা আছে কি? সেখানেও থেকে যাচ্ছে অনিশ্চয়তার মেঘ।
অষ্টম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে জায়গা করে দিতে পারলেও, প্রতিবন্ধী শিশু এবং শিক্ষকদের কেন চার দেওয়ালের নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত করা হল— সরকারের পক্ষ থেকে এ প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি এখনও। আর এই সমস্যার সমাধান? অমৃতা মুখোপাধ্যায় জানালেন, “যেকোনো প্রকল্পের সাফল্য নির্ভর করে তার প্রয়োগের ওপর। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই প্রকৃতির মাঝে পাঠদান চালু করেছিলেন শান্তিকেতনে। সরকারের প্রকল্পের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার প্রয়োগটা। এত কিছুর পরেও বলব, শিক্ষকদের সঠিক গাইডলাইন এবং ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করলে সফল হতে পারে এই প্রকল্প। শিক্ষকদের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার এটা একটা সুযোগও বটে।”
আজ থেকেই শুরু হয়ে গেছে শিশুদের ‘ওপেন এয়ার’ ক্লাস। এখন দেখার, বাস্তব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের তরফে তেমন কোনো গাইডলাইন এসে পৌঁছায় কিনা…
Powered by Froala Editor