সেদিনও হয়তো ঘরের বাইরে সারাদিন তুষার পড়ছিল ঝিরঝির করে, যেদিন প্রথম আঁকার ইচ্ছে মনে জাগে ভিনসেন্টের...
একটু বেশি বয়সেই ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন ডাচ শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ (Vincent Van Gogh)। আর্ট গ্যালারিতে ক্লার্ক, গির্জার সহকারী ও খনির শ্রমিকদেরকে সেবার কাজে ব্রতী ইভ্যাঞ্জেলিস্ট ভিনসেন্ট... প্রায়ই বিভিন্ন পেশাতে যুক্ত হয়েছেন। আবার কিছুদিনের মধ্যেই হারিয়েছেন মানসিক উৎসাহ। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছিলেন না যেন। ধার্মিক পরিবারের সদস্য হলেও একসময়ে ঈশ্বরের প্রতিও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন ভিনসেন্ট। উদ্দেশ্যহীন, ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ানোর সময় এমনই এক সাধারণ দিনে হাতে তুলে নিলেয়েছিলেন পেন্সিল। খাতায় আঁকতে শুরু করেছিলেন কয়লাখনির শ্রমিকদের যাপন-চিত্র। সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
ছবি আঁকার শুরুর দিকটা মসৃন ছিল না মোটেই। প্রথাগত কোনো শিক্ষা নেই। তাছাড়া তাঁর অঙ্কনশৈলীও প্রথা-বহির্ভূত। ছবি আঁকায় প্রেরণা জাগানোর মতো উৎসাহদাতাও কেউ ছিলেন না। শিক্ষক তো না-ই। নিজের কল্পনাপ্রবণ চিন্তাশক্তি ছাড়া আর কিছুই নেই। ছবি আঁকতে গিয়ে বারবার অনুভব করছিলেন ছবি আঁকার ফর্মাল গ্রামার তাঁর জেনে নেওয়াটা খুব প্রয়োজনীয়। অথচ হাতে তেমনটি সুযোগ-সুবিধেও নেই। হঠাৎই একদিন তাঁর মনে পড়ল রেভারেন্ড পিটারসনের কথা। যিনি গির্জায় পৌরোহিত্য করেন ঠিকই, তবে একজন কেউ চিত্রশিল্পীও বটে। একদিন পিটারসনের কাছে ভ্যান গঘ তাঁর কিছু ছবি নিয়ে গেলেন। পিটারসন ভ্যান গঘের একটি ছবি ক্যানভাসে রাখলেন এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভিনসেন্ট, কখনও ক্যানভাস আর ছবির অনুপাতের দিকটা চিন্তা করেছো কি?’ পিটারসন ছবির কিছুটা অংশ মুছে, স্কেল পেন্সিল নিয়ে সেটাকে খানিকটা পরিমার্জন করলেন। ভ্যান গঘ উত্তরে কোনো কথা না-বলে পাশের ক্যানভাসে আরেকটি প্রতিরূপ স্কেচ আঁকেন।
দুটো স্কেচকে পাশাপাশি দেখে পিটারসন চমকে যান। খানিক বিস্ময়ের সুরেই বলেন, “Now I get your point Vincent! I gave your picture the proportion, but took the character out of it!”
ছবির মূল চরিত্রকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারাটাই সাধারণ শিল্পী আর জাত শিল্পীর ফারাক, বুঝেছিলেন রেভারেন্ড পিটারসন।
ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ প্রতিটি রঙের নির্দিষ্ট একটা সঘন আবেগ আঁকতে সক্ষম ছিলেন। আর আবেগগুলোর ঠিকানা ছিল তাঁর স্নায়ুতন্ত্রের নির্দিষ্ট কোশগুলিতে। তাঁর আঁকা ছবিগুলোর প্রত্যেকটিই ছিল তীব্র আবেগের বহিঃপ্রকাশ, নির্দিষ্ট রং-এর সঠিক নিক্তিতে মাপা। আর সেই রঙের সঙ্গী ছিল তাঁর বাজপাখির মতো চোখ ও দুর্ধর্ষ ব্রেন ম্যাপিং-এর ক্ষমতা! ভাবনা, রঙের সাযুজ্য, উদ্দেশ্য ও ব্রেন ম্যাপিং-এর সংমিশ্রণে অজস্র ছবি এঁকেছেন ভিনসেন্ট। এমনকি মানসিক অবসাদের কালেও অ্যাসাইলামে তাঁর একান্ত কক্ষে বসে এঁকে গেছেন একের পর এক কালজয়ী ছবি। এঁকেছেন আশ্চর্য এক নীলিমায় তারাভরা রাত ও ভীষণ নিঃসঙ্গ এক চার্চকে ঘিরে সারিবদ্ধ সাইপ্রাস গাছে ঢাকা নিদ্রিত জনপদ। অলৌকিক স্বর্গীয় ক্যানভাসে পৃথিবীর অন্যতম বিস্ময়কর ছবি ‘Starry night’। সে আরেক গল্প। হবে অন্য কোনদিনে।
ভ্যান গঘ তাঁর নিজের স্বাধীন ইচ্ছেখুশির ম্যাথমেটিকাল প্রিসিশনে আঁকার দুঃসাহস করতে পেরেছিলেন। তাঁর সমূহ ছবিই যেন প্রিয় হলুদ রঙের ব্যাকগ্রাউন্ডকে ছুঁতে এক একবার মেঘের মতোই পৃথিবীতে নেমে এসেছিল।
বৃষ্টি ও চোখের জলের ফারাকটুকু মৃত্যুদিনে বুঝিবা মুছে যায়। মাত্র আটতিরিশটা বছরের জীবন শেষ হওয়ার দিনটি বছর ঘুরে আবারও এসেছে। আজ তারার আকাশ থেকে ঝরে পড়া দুফোঁটা কান্নায় ভিজে উঠছে হলুদ গমের ক্ষেত, গহন সাইপ্রাসের বন। কাচের তুষারের পতনধ্বনিতে কোথাও ভাঙছে চোখের জলের বাঁধ...
Powered by Froala Editor