সিনেমা, সার্কাস অথবা জাদুকরদের যে প্রচারই হোক— সেটা যদি সুচতুরভাবে আলোয় আনা যায়, তবে তার প্রভাব কতটা শক্তিশালী হতে পারে, তার অনেক প্রমাণ দেওয়াও সম্ভব। যেমন, চিরাচরিত প্রথার বিপরীত দিকে ধাবিত করার সাহস ও বুদ্ধি ছিল জাদুসম্রাট পি.সি. সরকারের (সিনিয়র)।
বর্তমানে টেলিভিশন ও কম্পিউটারের দৌলতে বহু জিনিস আমরা দেখতে ও জানতে পারছি। সেটা কিন্তু আগে সম্ভব ছিল না। তার ওপর ‘লাইভ টেলিকাস্ট’— যা দেখাবে সেটাই দর্শক সরাসরি দেখে, তখন ভুল হলে তা শোধরাবার কোনো সুযোগ থাকে না।
জাদু শুধু মনোরঞ্জন শিল্প নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ এবং কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূরিকরণে এই শিক্ষার ভূমিকা আছে।
জাদুকরের অতি আশ্চর্য কাণ্ডকারখানা দেখে আমরা বিস্মিত হলেও তাঁকে আলৌকিক বা ভৌতিক ক্ষমতার অধিকারী বলে ভাবি না। মনে-মনে ভাবি, জাদুকর সূক্ষ্ম কৌশলে আমাদের চোখ আর মনকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়েছেন।
আরও পড়ুন
মানুষের হাড় দিয়েই তাক-লাগানো ভেল্কি, কলকাতা ভুলেছে মাদারি জাদুকর রহমতুল্লাকেও
জাদু আমাদের মনে বিস্ময় উৎপাদন করে, তার মূলে আমাদের এই তফাৎটা বুঝতে না পারা। জাদুকর যে ব্যাপারটা করে দেখাচ্ছেন, সেটাকে আমরা মিরাকল বা অলৌকিক বলে মনে করি।
আমরা বিজ্ঞানের যুগে বাস করছি। বিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে। বর্তমানে জাদু শিল্পে তুক্তাকের যুগ শেষ, কারণ যুদ্ধ এখন সময়ের সঙ্গে। অতীতে জাদু যে একটা শিল্প এটা বোঝাতে হয়েছে মানুষকে। বর্তমান প্রজন্মকে নতুনভাবে বাঁচার শক্তি দিয়েছে সেই অবহেলিত জাদুবিদ্যা। ভারতীয় জাদুবিদ্যার লুপ্ত গৌরব আবার ফিরে এসেছে, যেটা একসময় ছিল ভারতীয়দের তপস্যালব্ধ ও সহজাত। তাই প্রাচীন ভারতবর্ষকে বলা হত জাদুকরদের দেশ— ‘The Land of Mystery’.
আরও পড়ুন
জাদু করে মঞ্চে ‘হাজির’ করতেন নিরুদ্দেশ নেতাজিকে, চোখ বেঁধে বাইক চালিয়েছেন কলকাতার রাস্তায়
একবার জাদুকর পল মঞ্চে খেলা দেখাচ্ছেন। হঠাৎ এক ভদ্রমহিলার পোষ্য ছোটো কুকুরটা মঞ্চে উঠে ডাকতে শুরু করে দেয়! জাদুকর পল টপ্ করে কুকুরটাকে কোলে তুলে মাইকের সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘কুকুরদাদা, আমার ম্যাজিক তোমার কেমন লাগছে?’ এরপর কুকুরটা মানুষের গলায় জবাব দেয়— ‘চমৎকার, চমৎকার! তাই তো মঞ্চে এসে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
জন পল ছিলেন একজন স্বরক্ষেপক। কাজেই এ রকমভাবে মজা করাটা তাঁরই সাজে।
আরও পড়ুন
মৃত্যুশয্যাতেও ফেরাননি পিসি সরকারকে, হাসপাতালে শুয়েই জাদু দেখালেন সুশীলকুমার
যার কুকুর তিনি তাড়াতাড়ি ছুটে এসে নিয়ে গেলেন। আর সেদিনের দর্শকরা ভীষণভাবে একচোট মজা লুটে নিলেন।
অথর্ববেদে জাদুবিদ্যার উল্লেখ রয়েছে। আমাদের দেশে এই বিদ্যা প্রথমে ছিল গুরুমুখী বিদ্যা। পূর্ব আচার্যদের মহাপ্রস্থানের পর এই গুরুমুখী বিদ্যা প্রায় অবলুপ্তির পথে। তবে এখনও মাঝে মধ্যে বেদে-বেদেনীদের খেলা, ভানুমতীর খেলা, ভোজবাজি প্রভৃতি সেই ঐতিহ্যেরই অপসৃয়মান চিহ্ন।
বাজিকরেরাও আসলে জাদুকর। ‘ভানুমতীর খেল’ কথাটা খানিক প্রবাদ বা মিথ মেশা একটা শব্দ। ছোটবেলা থেকেই আমরা ভানুমতীর নামের সঙ্গে পরিচিত। আমরা রাস্তাঘাটে এই বাজিকরদের জাদু দেখা তাজ্জব বনে যেতাম।
বর্তমানে মোবাইল, শপিংমল, উনিশ-কুড়ি ইত্যাদি জমানার গা ঘেঁষে চলেছে প্রোমোটার নামক আর এক জাদুকরের ব্যবসা। আগে মাঠে ছিল ছোটোদের খেলার অধিকার, বর্তমানে মাঠ ভ্যানিশ হয়ে গেছে। গল্পের বই ছোটোদের আকর্ষণ ছিল, বর্তমানে বোকাবাক্সতে বিভিন্ন কার্টুন দিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আগে ঘরে ঘরে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প, ডাকাতের গল্প, মা-ঠাকুমা আমাদের শোনাতেন। এখন সবকিছুই লুপ্তপ্রায়। অথচ, প্রাচীন ‘জাহাঙ্গীরনামা’য় লেখা আছে কয়েকজন বাঙালি জাদুকরের বর্ণনা। তাঁরা কৌশলপূর্ণ খেলা দেখিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরকেও। কোথায় গেল সেই আভিজাত্য?
সাধারণ কয়েকটা কাপড়ের ফালিকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে নিয়ে সেলাই করে যখন সেটা ভারতীয় পতাকায় রূপ নেয়— তখন সেটা শুধু কাপড়ের ফালি থাকে না, জোর করে আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। জাদুও ঠিক তেমনই। বিস্ময় ও শ্রদ্ধার। আমরা যেন তা ভুলে না যাই...
Powered by Froala Editor