হাসপাতালের ডাক্তারবাবু রাউন্ডে বেরিয়েছেন। পোশাকের ওপর পলিথিনের জামা, প্যান্ট। মুখে ডবল মাস্ক। হাতে গ্লাভস।
পেশেন্টের বুক-পিঠ স্টেথোস্কোপ দিয়ে টেস্ট করলেন। টেম্পারেচার চেক করলেন। তৃপ্তির একটা মৃদু হাসির ঝলক ছড়াল ডাক্তারবাবুর ঠোঁটে। মুহূর্তের জন্য পেশেন্ট আর ডাক্তারের চোখাচোখি হল।
ভয় নেই, বললেন ডাক্তারবাবু, সরকারি প্রোটোকল তো মানতেই হবে। তাই আপনাকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। আর দেখবেন, আপনার সোয়াবের কোভিড-১৯ টেস্টের রিপোর্ট নেগেটিভই আসবে।
যখন ফিরে যাচ্ছেন, হঠাৎই পেশেন্ট একটা অদ্ভুত আবদার করল, ডাক্তারবাবু, আমাকে কয়েক সিট কাগজ আর একটা পেন দেবেন?
ডাক্তারবাবু এরকম প্রশ্ন শুনে অবাক, চিঠি লিখবেন? তারপর মৃদু হেসে বললেন, নাকি, প্রেমপত্র?
নাঃ। এই বুড়ো বয়সে আর কাকে প্রেমপত্র লিখব? - আসলে মাথায় একটা গল্পের প্লট এসেছে। সেটাই লিখে ফেলতে চাইছি। জানেন, ডাক্তারবাবু, গল্পের আইডিয়াগুলো বিদ্যুৎ ঝলকের মতো। আসে আর পালায়। ধরে রাখা বড় দায়।
তাই? আপনি গল্প লেখেন? মানে, গল্প লেখক?
হ্যাঁ। ঐ আর কী। একটু আধটু লিখি। আমার দুটো বই বেরিয়েছে। প্রথমটা প্রায় শেষ। রিপ্রিন্ট করতে হবে।
আমাকে পড়তে দেবেন? পড়তে বড়ো ভালবাসি। আপনি একজন গল্পলেখক। আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগল। দেখি, আপনাকে সাহায্য করতে পারি কিনা?
দেখি বললে হবে না। দিতেই হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
ডাক্তারবাবুও একজন গল্পলেখককে হাতের কাছে পেয়ে আনন্দে উৎফুল্ল। ছুটতে ছুটতে গিয়ে নিজের রাইটিং প্যাডের খান দশেক পাতা ছিঁড়ে নিয়ে এসে গল্পলেখকের কাছে হাজির, এই নিন আপনার কাগজ। এতে হবে তো?
নিশ্চয়ই। আর একটা পেন?
আনন্দের আতিশয্যে ডাক্তারবাবু চট করে নিজের পেনটাই গল্পলেখকের হাতে ধরিয়ে দিলেন এমন একটা ভঙ্গিতে, যেন পবিত্র কিছু তুলে দিছেন। ভাবলেন, আমার এই পেন দিয়ে গল্প লেখা হবে। পেনটা ধন্য হয়ে যাবে। নাঃ। এ পেন আর ব্যবহার করব না। একে যত্ন করে রেখে দেব আলাদা করে।
ইতিমধ্যে হাসপাতালের চেম্বারে ফিরেছেন। লেখার জন্য আলাদা পেন যোগাড় হয়ে গেছে। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন হাসপাতালের নানান কাজে। এক সময় রিলিভিং ডাক্তার এসে হাজির। এবার বাড়ি ফেরার পালা।
নতুন টাটকা গল্প পড়ার লোভে দ্রুত এসে হাজির হলেন গল্পলেখকের কাছে, হয়েছে?
হ্যাঁ। এই মাত্র শেষ হল। একটু কাটা ছেঁড়া আছে। আপনার হয়তো পড়তে একটু অসুবিধা হবে।
না, না, কোনো অসুবিধা হবে না।
বাড়ি ফেরার আগ্রহে ইতিমধ্যে হাতের গ্লাভস খোলা হয়ে গেছে। এক ঝটকায় গল্প লেখা কাগজগুলো তুলে নিলেন। পেনটা নিয়ে অভ্যাসবশত বুক পকেটে গুঁজে রাখলেন। না। এ পেন দিয়ে আর লিখবেন না। হাতছাড়াও করবেন না।
একটুও দেরি না করে গল্পের পাতাগুলো নিয়ে ছুটলেন নিজের চেম্বারে, পড়বেন বলে। পড়ে, ফেরত দিয়ে তবে বাড়ি ফেরা।
এই চৈত্র মাসের শেষে বোশেখের দোরগোড়ায় বাইরে কি বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটল?
যখন উনি বিনা গ্লাভস হাতে গল্পলেখকের হাত থেকে পেনটা ফেরত নিলেন, বজ্রপাতটা কি ঠিক তখনই ঘটল?
পরদিন ডাক্তারবাবু হাসপাতালের আইসোলেশনে।