রাজ্যের রূপান্তরকামীদের জন্য প্রথম ‘আস্তানা’ দক্ষিণ কলকাতায়

সমাজে সচেতনতা তৈরি কাজটাও যেমন এগোচ্ছে, তেমনই এখনও বহু প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে যেতে হয় রূপান্তরকামী মানুষদের। এই লড়াই নিজের ভিতরে এবং বাইরে, ঘরে এবং ঘরের বাইরে। শুধুমাত্র সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়মে জন্মাতে পারেননি বলেই কী মেনে নিতে হবে এই দুর্ভাগ্য? কাউকে নিজের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করার জন্য ঘর ছাড়তে হয়, কেউ আবার ঘরভাড়া বা তেমন কোনো আশ্রয়ও পান না। তবে এইসব অসহায় মানুষদের জন্য এবার শহর কলকাতার বুকে তৈরি হল বিশেষ হোম। ছোট্ট একটি ঘর। নাম ‘আস্তানা’। মাথার উপর এমন একটা নিরাপদ ছাদ নিশ্চই রূপান্তরকামী মানুষদের লড়াইকে আরও শক্তি জোগাবে।

কলকাতার বুকে লড়াকু রূপান্তরকামী মানুষ এবং তাঁদের সহানুভূতিশীল মানুষদের উদ্যোগেই গড়ে উঠল ‘আস্তানা’। দক্ষিণ কলকাতার একটি বাড়িকে ঘিরে শুরু হল পথচলা। আপাতত ৬ থেকে ১০ জন আবাসিকের থাকার ব্যবস্থা আছে এই বাড়িতে। এই রাজ্যে রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য এই প্রথম বিশেষ আশ্রয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হল। রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডের প্রাক্তন সদস্য রঞ্জিতা সিনহা এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, “এখানে তো কোনো আলাদা খোপ তৈরি করতে আমরা চাইছি না। আমরা বলছি এটা মানুষের আন্দোলন। একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য বাকিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। এভাবেই তো সমাজ গড়ে উঠবে।”

‘আস্তানা’-র যাত্রাপথ নিয়ে বলতে গিয়ে রঞ্জিতা সিনহা জানিয়েছেন, আপাতত স্বল্পকালীন একটি আশ্রয় হিসাবেই চালু হতে চলেছে এই উদ্যোগ। “আসলে এটা ঠিক একটা থাকার জায়গা নয়। সপ্তাহ খানেকের বেশি হয়তো আমরা কাউকেই রাখতে পারব না। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই তাঁদের খানিকটা লড়াইয়ের শক্তি সংগ্রহ করতে সাহায্য করাই আমাদের উদ্দেশ্য। সেইসঙ্গে তাঁদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের বিষয়েও নজর রাখা হবে। প্রয়োজনে আইনি সাহায্যের ব্যবস্থাও করব আমরাই।”

এদেশে এখনও কর্মক্ষেত্রে প্রায় কোনো সুযোগই পান না রূপান্তরকামী মানুষরা। “দীর্ঘ আন্দোলনের পর যখন মহিলারাই কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা পান না, সেখানে আমাদের কথা তো ছেড়েই দিন”, বলছিলেন রঞ্জিতা সিনহা। ‘আস্তানা’ চেষ্টা করবে রূপান্তরকামী মানুষদের স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করতে। আর এই আগামী লড়াইয়ের প্রস্তুতির জন্য কয়েকটা দিন যাতে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন তাঁরা, সেটুকুই উদ্দেশ্য রঞ্জিতা সিনহা ও তাঁর সহযোগীদের। “খুব বেশি সামর্থ্য তো নেই আমাদের। তবে আশা রাখি আগামী দিনে সরকার এই ধরনের উদ্যগের পাশে এসে দাঁড়াবে। জাতীয় রূপান্তরকামী পরিষদ গঠন হয়ে গিয়েছে, দেশজুড়ে কাজের প্রেক্ষাপট তৈরি। তার মধ্যেই নিজেদের মতো করে খানিকটা চেষ্টা করলাম আমরা।” বাকি দায়িত্বটুকু সবাই মিলেই পালন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন
কলকাতার বাসে চালু হচ্ছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য সংরক্ষিত আসন

২০১৪ সালে নালসা আইন প্রথম দেশে রূপান্তরকামী মানুষদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়। ২০১৯ সালে অবদমনকারী ৩৭৭ ধারা রদ করা হয়। কিন্তু এসবের মধ্যেও সামাজিক স্তরে অবস্থাটা খুব একটা বদলায়নি। ২০১৯ সালের একটি রিপোর্ট বলছে দেশের রূপান্তরকামী মানুষদের ৮৫ শতাংশই নিজের পরিবারের কাছে স্বীকৃতি পান না। কেউ কেউ বাড়ি ছেড়ে হারিয়ে যান, কারোর ঠিকানা হয় ‘হিজড়া খোলা’। এসবের মধ্যে মানুষের মতো বাঁচার স্বপ্ন বা সুযোগ কোনোটাই আর থাকে না। তবে ‘আস্তানা’য় তাঁরা নতুন করে সেই স্বপ্ন দেখার সাহস ফিরে পাবেন, এমন আশা করাই যায়। সারা দেশের চেহারা হয়তো বদলাবে না এতে। কিন্তু এই ছোট উদ্যোগটিই যে এই মুহুর্তে বিশেষভাবে প্রয়োজন ছিল, সেকথা বলাই বাহুল্য।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
পৃথিবীতে প্রথমবার, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে স্বীকৃতি পেলেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও