৯৫-এ পা নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের, কিংবদন্তি পরিচালকের স্মৃতিচারণায় বিশেষ অনুষ্ঠান উত্তরপাড়ায়

“আমি তখন সুব্রত মিত্রকে নিয়ে একটি ছবি করছি। সেই সূত্রেই ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ। পরবর্তীতে বংশী চন্দ্রগুপ্ত-এর তথ্যচিত্র নির্মাণের সময় উনি খুবই সাহায্য করেছিলেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, আমাদের মতো নতুন ও আনকোরাদের এত উৎসাহ দিতেন যে মনেই হত না উনি এত বড়ো মাপের একজন পরিচালক। একেবারে ঘরের মানুষের মতোই…”

বলছিলেন ‘জীবনস্মৃতি আর্কাইভ’-এর অবেক্ষক অরিন্দম সাহা সরদার। আর তাঁর স্মৃতিচারণে যে মানুষটির কথা উঠে আসছিল বার বার, তিনি আর কেউ নন পরিচালক নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায় (Nripen Gangopadhyay)। অবশ্য সিনেমাপাড়ায় তিনি বেশি পরিচিত ‘ন্যাপাদা’ হিসাবে। গত বছর ২৩ অক্টোবর ৯৪ বছর বয়সে চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন কিংবদন্তি পরিচালক। আজ ৯৫ পূর্ণ করলেন তিনি। তাঁর প্রয়াণ-পরবর্তী প্রথম জন্মদিনে আজ উত্তরপাড়ার জীবনস্মৃতি আর্কাইভে আয়োজিত হতে চলেছে এক বিশেষ অনুষ্ঠান। নেপথ্যে ‘জীবনস্মৃতি আর্কাইভ’, ‘চৌরঙ্গী’ পত্রিকা এবং ‘হিন্দমোটর ফোকাস’।

সদ্য দেশ স্বাধীন হয়েছে তখন। তার কিছুদিন পর ভারতলক্ষ্মী স্টুডিও-তে ল্যাবরেটরি সহকারী হিসাবে যুক্ত হন নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়। ধীরে ধীরে টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়াই হয়ে উঠেছিল তাঁর পরিবার। বাংলা চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরাই ছিলেন সেই বৃহত্তর পরিবারের সদস্য। বিগত প্রায় ৭৫ বছর ধরে চলচ্চিত্রজগতের নানান আন্দোলন, উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছেন আমৃত্যু বামপন্থী পরিচালক। সেদিক থেকে তিনি যেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক জীবন্ত জীবাশ্ম।

আরও পড়ুন
ইতি সত্যজিৎদা—

“যে-সময় মানুষের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার কথা, সে-সময়েও অক্লান্তভাবেই নিজের কাজ চালিয়ে গেছেন তিনি। নৃপেনবাবুর মতো মানুষদের থেকে এটাই শেখার। শেষ বয়সেও উনি নিয়মিত নিজে হাতে লিখতেন। ওঁর মৃত্যুর পরেও একাধিক পত্র-পত্রিকায় ওঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকৃত অর্থেই নৃপেনবাবু একজন কর্মী মানুষ। ওঁর জন্মদিন পালনের একটি উদ্দেশ্য হল, ওঁর কাজগুলো স্মরণ রেখে কাজের ধারাটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া”, জানালেন ‘ন্যাপাদা নাইন্টিফাইভ’-অনুষ্ঠানের অন্য এক উদ্যোক্তা তথা ‘চৌরঙ্গী’ পত্রিকার সম্পাদক শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। 

আরও পড়ুন
চিঠি লেখেন সত্যজিৎ

সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে আজ হাজির থাকবেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক রাজা মিত্র, সাংবাদিক সজল দত্ত, প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট মানুষরা। থাকবেন নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিবারের সদস্যরা, তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরাও। স্মৃতিচারণায় উঠে আসবে নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনের নানান জানা-অজানা আঙ্গিক। তাছাড়াও এস্রাজপরিবেশ করবেন দীপেশ ভট্টাচার্য। 

আরও পড়ুন
সত্যজিতের পর বার্লিনজয়ী দ্বিতীয় বাঙালি তিনি, প্রয়াত পরিচালক নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়

তবে এই অনুষ্ঠানের শিকড় বিস্তৃত আরও দূর পর্যন্ত। আদতে নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো মানুষরা সেলিবের তকমা গায়ে চাপাননি কখনোই। বরং, চিরকালই আড়াল করে রেখেছেন নিজেকে। আর সেই কারণেই বোধ হয় বাংলার বৃহত্তর পাঠক ও দর্শকমহলের কাছে পৌঁছেছে তাঁর কাজের কিছু খণ্ডচিত্র মাত্র। আজও অধরা তাঁর সামগ্রিক কর্মজীবন। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ‘চৌরঙ্গী’ এবং ‘জীবনস্মৃতি আর্কাইভ’। ২০১৮ সালে নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়ের উপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল ‘চৌরঙ্গী’ পত্রিকা। সেই সংখ্যাই আগামীতে প্রকাশিত হতে চলেছে পরিবর্তিত চেহারায়। তাছাড়াও ‘জীবনস্মৃতি আর্কাইভ’ ও ‘চৌরঙ্গী’-র যৌথ উদ্যোগে সংকলিত হতে চলেছে তাঁর সমগ্র কর্মজীবনের নথিপত্র। তাঁর ব্যবহৃত জিনিস, সিনেমার চিত্রনাট্য, ছবির ভাবনা এবং আলোকচিত্র নিয়ে সংগ্রহশালা তৈরির পরিকল্পনাও চলছে সমানভাবে। 

শুধু সাহিত্য কিংবা চলচ্চিত্রের চর্চাই নয়, তরুণ প্রজন্মকেই আজীবন প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানের আরেক আয়োজক সোহম দাসের কথায়, “নৃপেনবাবু কোনো বাছবিচার করতেন না। ওঁর কাছে সাহায্য চেয়ে ফিরতে হয়নি কাউকেই। এবং চলচ্চিত্র সম্পর্কে ওঁর যা জ্ঞান, পড়াশোনা এবং বোধ ছিল— এককথায় তা অভাবনীয়।” চিরতরুণ এই ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর সংকলিত কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা যে তরুণ প্রজন্মের সামনে গবেষণার নতুন দিগন্ত খুলে দেবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? আজকের অনুষ্ঠানের সূত্র ধরেই যেন গড়ে উঠতে চলেছে ধারাবাহিক চর্চার সেই অভ্যাস…

ছবি ঋণ : জীবনস্মৃতি আর্কাইভ

Powered by Froala Editor

More From Author See More