একুশ শতকের দাঁড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে চর্চিত বিষয় হল জলবায়ু পরিবর্তন। আমরা সকলেই অল্প-বিস্তর জানি, কার্বন কিংবা গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন ত্বরান্বিত করছে এই পরিস্থিতিকে। কার্বন নির্গমন পরিবেশে কীভাবে প্রভাব ফেলছে— তা নিয়ে তৈরিও হয়েছে একাধিক তথ্যচিত্র। হচ্ছে লেখালিখিও। কিন্তু কীভাবে বাগে আনে যায় এই পরিস্থিতিকে? বাণিজ্যিক স্তরে কীভাবে লড়াই করা যায় কার্বন নির্গমনের সঙ্গে? এতদিন পর্যন্ত শুধুমাত্র অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহারেই এই সমস্যার সমাধান খুঁজেছি আমরা। নিত্য-নতুন উদ্ভাবনী বাজারে এলেও, আমরাই যেন উপেক্ষা করেছি তাদের। এবার জনসচেতনতা গড়ে তুলতে এইসমস্ত প্রযুক্তিকে নিয়েই তৈরি হল আস্ত একটি তথ্যচিত্র। ইতিমধ্যেই মুক্তি পেয়েছে আই-প্লেয়ার প্ল্যাটফর্মে।
দ্য আর্ট অফ কাটিং কার্বন (The Art Of Cutting Carbon)। হ্যাঁ, এই তথ্যচিত্রের হাত ধরেই উঠে এল কাগজ মুদ্রণ থেকে শুরু করে স্টিল প্ল্যান্টের মতো নানান বাণিজ্যিক ও শিল্প ক্ষেত্রে কার্বন ছাঁটাই-এর অদ্ভুত সব পদ্ধতি। আর এই অভিনব তথ্যচিত্রটির পিছনে রয়েছে পরিবেশবিদ, বিশ্লেষক এবং বিবিসির সাংবাদিক রজার হেরাবিন। এই তথ্যচিত্রটিতে মূলত বিভিন্ন স্বল্প-চর্চিত কার্বন উৎসের দিকে আলোকপাত করেছেন তিনি। দেখিয়েছেন কীভাবে প্রযুক্তির সাহায্যে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এই নির্গমন।
শক্তি উৎপাদনে কয়লা এবং পেট্রোপণ্যের ব্যবহারে নির্গত হয় প্রচুর পরিমাণে কার্বন। তবে শতাংশের বিচারে এর থেকেও বেশি কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী কাগজ, প্লাস্টিক, স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশ্বের সেরা কিছু কার্বন কাটিং প্রযুক্তিকে তুলে ধরেছেন রজার।
এই তালিকায় সবার শীর্ষেই রয়েছে ‘ডি-প্রিন্টার’ নামের এক জাদুকরী গ্যাজেট। হ্যাঁ, নাম থেকেই অনুমান করা যায় এই যন্ত্রের কার্যকলাপ। লেজারের সাজায্যে যা ছাপা কাগজ থেকে অনায়াসেই কালি সরিয়ে ফেলতে পারে। ফলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে ব্যবহৃত কাগজ। সাধারণত, কাগজকে বায়োডিগ্রেডেবল হিসাবেই ধরে নিই আমরা। তা একশো শতাংশই ঠিক। কিন্তু কাগজের বিয়োজনে পরিবেশে নির্গত হয় বিপুল পরিমাণে কার্বন। এই বিষয়টি উপেক্ষা করে যাই আমরা। অন্যদিকে প্লাস্টিক তৈরির ক্ষেত্রেও জৈব অণুর পরিমার ব্যবহৃত হয়। সেখান থেকেও নির্গত হয় প্রচুর পরিমাণে কার্বন। প্লাস্টিক ও মাইক্রোপ্লাস্টিকের দূষণের পাশাপাশি এই কোকও জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ। নেদারল্যান্ডসের একটি সংস্থা জৈব-রাসায়নিক পদ্ধতিতে সমাধান খুঁজে দিয়েছে এই সমস্যার। পিইটি-খ্যাত একটি বিশেষ উদ্ভিজ্জ যৌগকে তাঁরা ব্যবহার করছেন প্লাস্টিক তৈরির কাজে। যা একদিকে যেমন বিয়োজনযোগ্য, তেমনই বিয়োজনের পর কার্বন নির্গমনের মানও কম।
প্লাস্টিক ও কাগজের বাইরে কার্বনের সবচেয়ে বড়ো উৎস ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম শিল্প। দুটি ক্ষেত্রেই আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশনের জন্য প্রয়োজন হয় ব্যাপক তাপমাত্রার। তার জন্য সাধারণত কয়লা বা পেট্রোলিয়াম জ্বালানিই ব্যবহার করা হয় শিল্পক্ষেত্রে। তাছাড়া স্টিল তৈরির সময় লোহার জারণে ব্যবহৃত হয় কাঁচা কার্বন। এই পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এনেছে সুইডেনের দুই সংস্থা। বক্সাইট থেকে অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে তাঁরা ব্যবহার করছেন জিওথার্মাল বা ভূগর্ভস্থ তাপশক্তি। অন্যদিকে কার্বনের জারণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে হাইড্রোজেন জ্বালানি। তাতে বায়ুতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিবর্তে নির্গত হচ্ছে জলীয় বাষ্প।
‘দ্য আর্ট অফ কাটিং কার্বন’-তথ্যচিত্রের প্রতিটি আঙ্গিকই নতুন করে সচেতনতা গড়ে তুলবে বলেই বিশ্বাস পরিচালক রজার হেরাবিনের। আগামীদিনে সবুজ পৃথিবী গড়তে এবং জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে এই পথেই হাঁটতে হবে সমগ্র মানব সভ্যতাকে। স্বল্প-চর্চিত এই বিষয়গুলি তুলে ধরে যেন এক বৃহত্তর পরিবেশ আন্দোলনের ডাক দিলেন রজার। এবার দেখার তাঁর এই আবেদনে আদৌ সাড়া দেয় কিনা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি…
Powered by Froala Editor