ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাবে করাল দাঁত, অভিনব ‘রেপ-এক্স’ কন্ডোম আবিষ্কার চিকিৎসকের

প্লাস্টিকের ছোট্ট ট্যাম্পুনের মতো দেখতে একটি জিনিস। বাইরে থেকে দেখলে প্রথমে সেরকম বিশেষত্ব হয়তো নজরে আসবে না। একটু কাছে গেলেই দেখা যাবে, প্লাস্টিকের খোলসের ভেতর সার দিয়ে আছে ধারালো দাঁতের মতো অংশ। কী এই জিনিস? পোশাকি নাম ‘রেপ-এক্স’। ভালো করে বললে, ধর্ষণ থেকে বাঁচার এক অমোঘ অস্ত্র।

একটু গোড়া থেকে শুরু করা যাক। ধর্ষণ সংক্রান্ত যাবতীয় আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাবে দক্ষিণ আফ্রিকা নামক দেশটির করুণ অবস্থা। বিশ্বের সবথেকে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে এই দেশটিতে। এটি কেবল সাম্প্রতিক সময়ের চিত্র নয়; বহু বছর ধরে পৃথিবীর ‘রেপ ক্যাপিটাল’ বা ধর্ষণ রাজধানী হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকা কুখ্যাত। আর সেখানেই ১৯৬৭ সালে মেডিক্যাল রিসার্চারের পেশায় এসেছিলেন ডঃ সনেট এহলারস। সেই সময়ই তাঁর সঙ্গে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। 

কর্মজগতে তখন এসেছেন বেশ কয়েক বছর হয়েছে। হঠাৎ এক রাতের বেলা তাঁর চেম্বারে হাজির হলেন এক তরুণী। বিধ্বস্ত চেহারা, চোখ দুটি প্রাণহীন, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। এক ঝলক তাকালেন ডঃ সনেট। কী সর্বনাশ হয়েছে, বুঝতে বাকি রইল না আর। কাছে এসে বসলেন তিনি। তরুণী অঝোরে কেঁদে চলেছে, সারা শরীর কাঁপছে। এমন সময় তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অদ্ভুত একটি কথা— ‘If only I had teeth down there’! যদি আমার ওই জায়গাতেও দাঁত থাকত… 

কথাটা কানে গেঁথে গেল ডঃ সনেট এহলারসের। কতটা যন্ত্রণা থেকে এই কথাটি বলেছেন ওই ধর্ষিতা তরুণী। আর এটা তো কোনো বিচ্ছিন্ন বাক্য নয়! দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিটা বাড়িতে, প্রতিটা রাস্তার মোড়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। দেশ ছেড়ে বিশ্বের দিকে তাকালেও ছবিটা বদলায় না। মেয়েরা সেখানে অবহেলিত, নিষ্পেষিত। তাঁরা যেন ‘ভোগের বস্তু’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সনেট ঠিক করলেন, এমন একটা কিছু তৈরি করবেন যাতে মেয়েরা আত্মরক্ষার অস্ত্র খুঁজে পায়। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, সমস্ত বিশ্বের ছবিটা যেন বদলে যায়… 

তারপর কেটে গিয়েছিল ৪০টি বছর। এই ক’বছরে আরও রক্তাক্ত হয়েছে মেয়েরা। নতুন একটি শতাব্দীতে পা রেখেছে পৃথিবী। আর সেখানেই সনেট এহলারস নিয়ে এলেন তাঁর সেই কাঙ্খিত অস্ত্র— ‘রেপ-এক্স’। দেখতে অনেকটা কন্ডোমের মতো, প্লাস্টিকের স্বচ্ছ একটি জিনিস। আপাতভাবে নিরীহ জিনিসটির ভেতরের দেওয়ালে রয়েছে কাঁটার মতো অংশ। সেগুলো এমনভাবে বসানো যে, ভেতরে বাধাহীনভাবে কিছু ঢুকে যেতে পারে। কিন্তু বের করতে গেলেই সেই জিনিসটির ওপর চেপে বসবে ধারালো কাঁটা। ঠিক যেন ‘দাঁত’। যত বের করার চেষ্টা করা হবে, ততই কাঁটা চেপে বসবে ওর ওপর। ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া তখন আর কোনো উপায়ও নেই। 

ডঃ সনেট বললেন, এই ‘রেপ-এক্স’ ফিমেল কন্ডোমটি মেয়েরা নিজের যোনিতে প্রবিষ্ট করে রাখতে পারবে। এর ফলে তাঁদের কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু যদি তিনি ধর্ষণের পরিস্থিতিতে পড়েন, তবে ধর্ষকদের ক্ষেত্রে যম হয়ে হাজির হবে এই বস্তুটি। আর যদি সেটি হয়, তবে ধর্ষকদের ধরাও অনেকক্ষেত্রে সহজ হয়ে যাবে। ২০০৫ সালে সর্বপ্রথম এই বস্তুটিকে সামনে আনেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় জেবার ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হল, তখনই আরও বেশি করে প্রচার আরম্ভ করেন সনেট। লক্ষ্য একটাই, দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ মানুষরা তো বটেই; গোটা বিশ্বের কাছে যেন এই ‘রেপ-এক্স’-এর খবর পৌঁছে যায়। 

আরও পড়ুন
ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, নতুন আইন জারি বাংলাদেশে

এমন খবর সামনে আসার পর রীতিমতো হইচই শুরু হয়ে যায় সব মহলে। সেইসঙ্গে চলে এই বিশেষ জিনিসটি নিয়ে কাঁটাছেঁড়া। বেশ কিছু মহলে প্রশ্ন ওঠে এর ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে। এটি কি আদৌ মেয়েদের জন্যও সুরক্ষিত? এহলারস অবশ্য বলেন, এই কন্ডোমটি ধর্ষকদের পুরুষাঙ্গে বিঁধে গেলেও, এটি একেবারে গভীরে গিয়ে আঘাত করবে না। কারণ, ধারালো দাঁতগুলির আকার। আর মেয়েদেরও কোনোরকম ক্ষতি করবে না। 

দুর্ভাগ্যের কথা, এখনও বাজারে বাণিজ্যিকভাবে আসেনি ‘রেপ-এক্স’। বহু পরিকল্পনা হয়েছে, হচ্ছেও; নতুন করে অর্থ সংগ্রহের কাজও শুরু হয়েছে। ডঃ সনেট এহলারস এবং তাঁর দল চেষ্টা করছেন নিজেদের মতো। কিন্তু এখনও মানুষের হাতে পৌঁছয়নি ‘রেপ-এক্স’। কতটা উপকার হবে, কতটা বদলাবে পরিস্থিতি, সেসব এখনও অজানা। এদিকে ধর্ষণও থেমে নেই। দক্ষিণ আফ্রিকা এখনও তার তকমা হারায়নি। সেইসঙ্গে গোটা বিশ্বেও বেড়ে চলেছে নির্যাতন। ভারতে একের পর এক ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। কেবল একটি রেপ-এক্সেই কি থেমে যাবে এমন বর্বরতা? সমাজতাত্ত্বিক, মনোবিদরা বলেন ধর্ষণের মতো অসুখ আসলে আমাদের মনেই বসবাস করে। এখান থেকে বেরোতে গেলে আমাদের মানসিকতার ই সার্বিক পরিবর্তন দরকার। সেইসঙ্গে সুরক্ষা তো আছেই। আমরা কি সত্যিই সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছি? এরকম নানা প্রশ্ন উঠে আসে… 

তথ্যসূত্র-
১) ‘South African doctor invents female condoms with ‘teeth’ to fight rape’, Faith Karimi, CNN
২) ‘RapeX, the South African anti-rape condom’, David Mikkelson, Snopes
৩) Rape-axe.com 

আরও পড়ুন
ধোনির ছোট্ট মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি; ক্রিকেট কি এই শিক্ষাই দিচ্ছে আমাদের?

Powered by Froala Editor