মিটার দুয়েক দীর্ঘ ছোট্ট একটি নৌকো। তার ভেতরেই কোনোক্রমে থাকবার বন্দোবস্ত। খাবার ও পানীয় জল রাখার ছোট্ট কেবিন। বাইরে শক্তি উৎপাদনের জন্য সোলার প্যানেল। তবে এই ছোট্ট নৌকা উত্তাল সমুদ্রের সামনে নিতান্তই শিশু। কিন্তু এমন নৌকোয় চেপে যদি আন্টার্কটিকা মহাদেশে (Antarctica) পৌঁছে যাওয়া যায়? তাও আবার কেবলমাত্র দাঁড় টেনে?
শুনলে অবাস্তব মনে হওয়া স্বাভাবিক। এমনকি এতদিন পর্যন্ত তা অসম্ভব বলে মনে করত মানুষ। হাওয়ার বেগ যেখানে ১২০ কিলোমিটার প্রতিঘণ্টা, কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়া, প্রতি মুহূর্তে ধেয়ে আসছে ১০-১২ মিটার উঁচু হিমশীতল ঢেউ— সেখানে এমন ডিঙিতে করে পাড়ি দেওয়া যায় নাকি? তবে সম্প্রতি এই অসম্ভবকেই জয় করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন স্প্যানিশ অ্যাডভেঞ্চার অ্যাথলিট অ্যান্তোনিও দে লা রোসা। না, সফল হননি তিনি। তবে লক্ষের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েই এক নতুন নজির তৈরি করলেন দে লা রোসা।
৭ জানুয়ারি, ২০২৩। দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণতম বিন্দু কেপ হর্ন থেকে দে লা রোসা ‘ওসান ডিফেন্ডার’-খ্যাত ছোট্ট নৌকায় চেপে পাড়ি দিয়েছিলেন আন্টার্কটিকার উদ্দেশে। তবে প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল বহু আগে থেকেই। ‘ওসান ডিফেন্ডার’ নামের এই নৌকাটির নকশা তাঁর নিজেরই তৈরি। পাশাপাশি স্প্যানিশ জাহাজ-নির্মাণ কারখানায় স্বয়ং হাজির থেকেই এই নৌকা প্রস্তুত করান তিনি। নৌকার বাহ্যিক গঠন এমনভাবেই তৈরি করা হয়, যাতে সমুদ্রের স্রোতের আঘাতে তা উল্টে গেলেও, ফের সোজা হয়ে যায় প্লবতার কারণে। সেইসঙ্গে বিশেষভাবে নজর দেওয়া হয়েছিল তাঁর অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিন বর্তনী এবং দৃঢ়তায়। অন্যদিকে উত্তাল সমুদ্রে নিজে যাতে নৌকা থেকে ছিটকে না পড়ে যান, তার জন্য পর্বতারোহণে ব্যবহৃত মজবুত দড়ি দিয়েই নিজেকে নৌকার সঙ্গে বেঁধেছিলেন তিনি। কিন্তু প্রকৃতির সামনে সত্যিই কি দানা বাঁধতে পারে প্রযুক্তি?
না, পারেনি। ১২০ কিমি প্রতি ঘণ্টা বেগে বয়ে চলা বাতাস তাঁকে টেনে নিয়ে চলে উত্তর-পূর্ব দিকে। এই বাতাসকে প্রতিহত করে মানুষের পক্ষে দাঁড় টেনে চলা প্রায় অসম্ভব। তাও হাল ছাড়েননি দে লা রোসা। ১২ দিনের মাথায় এলিফ্যান্ট আইল্যান্ডের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছান তিনি। উল্লেখ্য, দে লা রোসের পরিকল্পনা ছিল, যাত্রাপথে এই দ্বীপে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নেওয়া। তবে তা আর হয়ে ওঠেনি। কারণ, সমুদ্রস্রোত এবং বায়ুপ্রবাহ এই দ্বীপের প্রায় ২০০ কিলোমিটার উত্তরে নিয়ে চলে যায় তাঁর নৌকা। দ্রাঘিমাংশ ধরে দক্ষিণে নৌকা নিয়ে চলা কার্যত অসম্ভব। তাই বিশ্রামের আশা ছাড়েন দে লা রোসা। সঙ্গে এও বুঝতে পারেন লক্ষমাত্রায় পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব।
এত দু’দিন পর, আরও ভয়াবহ এক ঘটনার শিকার হন স্প্যানিশ অভিযাত্রী। উত্তাল ঢেউয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তার নৌকা। পর পর দু’বার ৩৬০ ডিগ্রি উল্টে যায় সেটি। নৌকার ছোট্ট কেবিনে তখন সন্ধ্যাহার সারছেন দে লা রোজা। হু হু করে ঢুকে আসে জল। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল সেখানেই যেন সব শেষ। যদিও শেষ অবধি নৌকার ওপরে অবস্থিত এয়ার ট্যাঙ্ক আবার সাম্যে নিয়ে আসে ছোট্ট জলযানটিকে।
তবে প্রাণ বাঁচলেও, মাঝ-সমুদ্রে তাঁর টিকে থাকাকে অসম্ভব করে তুলেছিল এই ঘটনা। সমুদ্রের লবণাক্ত জল ঢুকে খারাপ হয়ে যায় একাধিক সার্কিট। কাজ করা বন্ধ করে দেয় ভিএফএইচ রেডিও, জিপিএস লোকেটার, ওয়াটার পিউরিফায়ার। এমনকি খারাপ হয়ে যায় নৌকার ভেতরে অবস্থিত পাম্পও। একক প্রচেষ্টায় রেডিও, জিপিএস ও অন্যান্য বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম সারিয়ে তুললেও, নৌকার পাম্প সারাতে পারেননি দে লা রোসা। পরবর্তী ১২ দিন বালতি করেই তাঁকে ক্রমাগত জল বার করতে হয়েছে নৌকার ভেতর থেকে। অভিযাত্রীর কথায়, সবমিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০০ লিটার জল অপসারণ করেছেন তিনি।
২৬ দিনের মাথায় আন্টার্কটিক অঞ্চলে অবস্থিত সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে পৌঁছান দে লা রোসা। সবমিলিয়ে ততক্ষণে প্রায় ২৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া হয়ে গেছে তাঁর। অথচ, আন্টার্কটিকা যেই দূরত্বে, সেই দূরত্বেই। এই দ্বীপে এসেই নিজের অভিযান শেষ করেন তিনি। মজার বিষয় হল, মানবচালিত কোনো জলযানে চেপে এই দ্বীপে এখনও পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি কেউ-ই। বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি হিসাবেই এই নজির গড়েছেন স্প্যানিশ অভিযাত্রী। তবে নামের পাশে এমন অভিনব এক কৃতিত্ব জোড়ার পরেও বিন্দুমাত্র খুশি নন দে লা রোসা। আন্টার্কটিকা জয়ের জন্য পরবর্তীতে ফের সমুদ্রে নামার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর, এমনটাই জানাচ্ছেন তিনি।
তবে এই অভিজ্ঞতা ভোলবার নয় মোটেই। কখনও তাঁর সঙ্গ দিয়েছে সাঁতরে চলা পেঙ্গুইনের দল, কখনও আবার ডলফিন। আবার পাশ দিয়ে ছুটে চলা জাহাজ থেকে তাঁকে দেখে বিস্মিত হয়ে হাত নেড়েছেন মানুষজন। সেইসঙ্গে দে লা রোসা সামনে থেকে দেখেছেন দক্ষিণ মহাসমুদ্রে ভেসে চলা কয়েকশো টন প্লাস্টিকের স্তূপ। ছবিও তুলেছেন সে-সবের। পৃথিবী তথা প্রকৃতিকে বাঁচাতে আগামীদিনে এই ছবিই মানবজাতির হাতিয়ার হয়ে উঠবে বলেই আশাবাদী তিনি…
Powered by Froala Editor