সদ্যোজাত সন্তানের কান্নার ক্ষীণ শব্দ একবার কানে এসেছিল। তারপরেই সংজ্ঞা হারালেন মা। তবে জ্ঞান ফিরতে শুনলেন তিনি নাকি মৃত সন্তান প্রসব করেছেন। তাহলে কি সন্তানের কান্নার শব্দটা ভুল শুনেছিলেন মা? একজন দুজন নন, স্পেনের হাজার হাজার প্রসূতির সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটত কিছুদিন আগেও। মায়ের কোল থেকে চুরি হয়ে যেত শিশু। প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিত না, কারণ এই চুরি করার পুরো প্রক্রিয়াটিই চলত সরকারের মদতে। আর কাজটা করতেন চিকিৎসক এবং সন্ন্যাসিনীরাই।
১৯৩৫ সাল থেকে শুরু হয় স্পেনের গৃহযুদ্ধ। স্বৈরাচারী শাসক ফ্রান্সিস ফ্র্যাঙ্কোর বিরুদ্ধে বহু প্রজাতান্ত্রিক মানুষ জোট বাঁধতে শুরু করেছেন। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কোর সমর্থকের সংখ্যাও কম নয়। অচিরেই শুরু হল বিরোধিতা দমনের প্রক্রিয়া। ফ্র্যাঙ্কো বুঝেছিলেন, খুব তাড়াতাড়ি তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে যাতে এই বিরোধিতা ছড়িয়ে না পড়ে, তার জন্য আগে থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। তাই যে-কোনোভাবেই হোক, রিপাবলিকানদের কাছ থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে তাদের সন্তানদের।
চল্লিশের দশকের শুরু থেকেই স্পেনের জেলখানাগুলি ভরে যেতে শুরু করল রিপাবলিকানদের ভিড়ে। সমস্ত জেলে পরিকাঠামোর চেয়ে অন্তত ৩ গুণ বেশি কয়েদি। প্রয়োজনীয় খাবারের যোগান নেই। তখনও নিয়ম ছিল, মা জেলে থাকলে সন্তানকে সঙ্গে রাখতে পারবেন। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কো নিয়ম করে দিলেন, ৩ বছরের বেশি বয়সের কোনো সন্তানকে মা জেলে নিয়ে যেতে পারবেন না। আর তার একমাত্র কারণ, জেলের মধ্যে অত্যাচারের দৃশ্য দেখে শিশুর মনের মধ্যে যেন বিরোধিতা জন্ম না নেয়। অনেক সময়েই শিশুটির অন্য কোনো আত্মীয়ের সন্ধান পাওয়া যেত না। তখন তাকে তুলে দেওয়া হত কোনো ফ্র্যাঙ্কো সমর্থক দম্পতির হাতে। তবে এর মধ্যেই অনেক সময় শিশুকে তার বাবার কাছ থেকেও চুরি করে নিয়ে যাওয়া হত।
তবে এভাবেও সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হচ্ছিল না। তাই ফ্র্যাঙ্কো সমর্থকরা প্রত্যেকেই অন্য উপায়ের কথা ভাবছিলেন। এমন সময় অ্যান্টোনিও ভালেজো নাজেরা এবং গ্রেগরিও মারানন নামের দুই চিকিৎসক অন্য রাস্তা ঠিক করলেন। তাঁদের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছে হিউস্প্যানিক ইউজেনিক্স বা স্প্যানিশ জাতীয়তাবাদের ধারণা। তবে এই জাতীয়তাবাদ অনেকটাই আধুনিক। জন্মসূত্রে জাতীয়তায় বিশ্বাসী ছিলেন না ফ্র্যাঙ্কো সমর্থকরা। বরং তাঁদের বিশ্বাস ছিল দৈনন্দিন জীবনে মেনে চলা রীতিতেই। রিপাবলিকান বাবা-মায়ের প্রভাবে শিশুরা সেই সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত হোক, এমনটা হতে দেওয়া যায় না। তাই শুরু হল প্রসূতি মায়ের সন্তান চুরি।
আরও পড়ুন
বিদেশি সিনেমা দেখলেই মৃত্যুদণ্ড! স্বৈরাচারের জাঁতাকলে উত্তর কোরিয়া
১৯৭৫ সালে ফ্র্যাঙ্কো সরকারের পতন ঘটে। কিন্তু তারপরেও বন্ধ হয়নি শিশু চুরির ঘটনা। আজও হিস্প্যানিক ইউজেনিক্সের বিষাক্ত স্রোত বইছে স্পেনের শরীরে। ৯০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত এমন পরিকল্পিত শিশু চুরির নানা অভিযোগ উঠেছে। ২০১১ সালে আদালতে ওঠে প্রথম শিশু চুরির মামলা। ১৯৩৫-৭৫ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া ৫০ হাজারের বেশি মামলা জমা পড়েছে আদালতে। তবে অনেকের মতে সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। অন্তত ৩ লক্ষ শিশু চুরির ঘটনা ঘটেছে ফ্র্যাঙ্কো আমলে। আজও যে এমন ঘটনা ঘটে না, তেমনটা জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন
স্বৈরাচারের খবর তুলে ধরায় জেল মায়ানমারের সাংবাদিকের
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মঞ্চে স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গান, ৪৬টি গুলিতে ঝাঁঝরা হলেন ভিক্টর হারা