আজ থেকে ৪০০ বছর আগে এক ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগে কেঁপে উঠেছিল কাতালুনিয়ার (Catalonia) ভিলাদ্রাউ শহর। একটানা বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ঝড়বৃষ্টি চলছিল। আর তার সঙ্গেই আকস্মিকভাবে এসে পড়েছিল বন্যা। ছোট্ট শহরে যখন মানুষে মানুষে ঐক্যের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি, ঠিক সেই সময় ১৪ জন মহিলার বিরুদ্ধে উঠল এক অদ্ভুত অভিযোগ। প্রতিবেশিরা দাবি করলেন, এই মহিলারাই বন্যার জন্য দায়ী। গোপনে শয়তানের আরাধনা (Witchcraft) করেন তাঁরা। আর শয়তানের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তাঁরাই বন্যা ঘটিয়েছেন।
১৬১৭ সালের শেষদিকে নাগরিক জেলখানায় বন্দি করা হয় ১৪ জন মহিলাকে। আর তারপর শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার। মহিলারা প্রত্যেকেই ছিলেন নিঃসঙ্গ। কেউ বিধবা, কেউ আবার বয়স পেরিয়ে গেলেও বিবাহ করেননি। ফলে তাঁদের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য কেউই ছিলেন না। অত্যাচারের মুখে অনেকেই স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সত্যিই তাঁরা শয়তানের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বন্যা ঘটিয়েছেন। ১৬১৮ থেকে ১৬২২ সালের মধ্যে ১৪ জন মহিলাকেই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল নাগরিক আদালত। শুধু ৪০০ বছর আগের সেই একটি ঘটনাই নয়, ইউরোপের উইচ হান্টিং-এর ইতিহাসে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে স্পেনের ভিলাদ্রাউ শহরের নাম।
স্পেনের স্যাপিয়েন্স পত্রিকা এবং কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন মিলে সম্প্রতি ইউরোপের নানা দেশে উইচ হান্টিং-এর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মানুষদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, কেবলমাত্র সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকেই ইউরোপে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই ছিলেন মহিলা, বিশেষত বিধবা এবং পরিবারহীন মহিলারা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মহিলাকে হত্যা করা হয়েছে ভিলাদ্রাউ শহরে। ভাবতে অবাক লাগে, তখন সেই শহরের মোট জনসংখ্যা ছিল ১ হাজারেরও কম। তারপরেও ভিলাদ্রাউ হয়ে উঠেছিল ইউরোপের উইচ হান্টিং-এর কেন্দ্রস্থল।
ভিলাদ্রাউ শহরে উইচ হান্টিং-এর অভিযোগ অবশ্য বেশ পুরনো। সবচেয়ে পুরনো যে মামলাটির কথা জানা যায়, সেটি ১৪২৪ সালের। এরপর অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত সেই ধারা বহাল ছিল। এই সাড়ে তিনশো বছরে প্রায় এক লক্ষ মহিলাকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও মনে রাখতে চাননি সেইসব ভয়ঙ্কর স্মৃতি। তেমনই পেরি বেগাস ফর্মাৎজি নামের এক ব্যক্তি সম্প্রতি জানতে পেরেছেন, ১৬১৭ সালের সেই ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাঁরই পরিবারের একজনকে। অথচ ৪০০ বছর ধরে তাঁর নাম কেউ উচ্চারণও করেননি।
সময় বদলাচ্ছে। মধ্যযুগের সেইসব অপরাধের কথা স্বীকার করে নেওয়া এই সময়ের দাবি, এমনটাই মনে করছেন স্পেনের মানুষ। সম্প্রতি কাতালুনিয়ার আইনসভায় এই সংক্রান্ত বিলও পাশ হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই ১৪ জন মহিলার নামে রাস্তার নামকরণ করা হবে বলেও জানিয়েছেন ভিলাদ্রাউ শহরের মেয়র। স্যাপিয়েন্স পত্রিকার আধিকারিক ক্লউডিয়া পুজল বলেন, তাঁরা নিজেদের সেই অসহায় মহিলাদের উত্তরসূরি বলেই মনে করেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, তাঁরা আসলে সেইসব মানুষদের উত্তরসূরি, যাঁরা অসহায় মহিলাদের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে হত্যা করেছিল। পূর্বসূরিদের সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত তো এই সময়কেই করতে হবে।
Powered by Froala Editor