বাজি ধরে না-দেখেই বিমান অবতরণ, পাইলটের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বলি ৭০টি প্রাণ

কেউ যাচ্ছিলেন আত্মীয়ের বাড়ি, আবার কেউ পড়াশোনা কিংবা কর্মসূত্রে সফর করছিলেন ভিন্ন শহরে। এরই মধ্যে ঘোষণা হয়ে গেল আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অবতরণ করবে বিমান। ফলত, নামার জন্য তোড়জোড়ও শুরু করে দিয়েছিলেন কোনো কোনো যাত্রী। কিন্তু গন্তব্যে আর পৌঁছানো হল না। আকস্মিক ঝাঁকুনি খেয়ে উল্টে গেল বিমানটি। তারপরেই বিস্ফোরণ। কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ নাকি প্রতিকূল আবহাওয়া? না, কোনোটাই দুর্ঘটনার কারণ নয়! তবে?

প্যারিসের রাস্তায় চোখ বেঁধে মোটরবাইক চালিয়েছিলেন জাদুকর পি.সি. সরকার। কলকাতার রাস্তাতেও খ্যাতনামা ম্যাজিশিয়ানরা চোখে বেঁধে চালিয়েছেন জিপ গাড়ি। কিন্তু দৃষ্টিরুদ্ধ করে বিমানের অবতরণ? এ কথা আঁতকে ওঠার মতোই। তবে তেমনটাই ঘটিয়ে বসেছিলেন সোভিয়েতের (Soviet Pilot) এক বিমানচালক। আর তার জেরেই ঘটে গিয়েছিল সেই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা (Plane Accident)। সময়টা ১৯৮৬ সাল। ঠিক যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। কারণ, তার মাস ছয়েক আগেই চের্নোবিলে ঘটে গেছে বিশ্বের ভয়ঙ্করতম পারমাণবিক বিপর্যয়। সে ক্ষত তখনও দগদগে। তার মধ্যেই এমন এক প্রাণঘাতী ঘটনা। আর তার জন্য দায়ী ছিল স্বয়ং পাইলটের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আর অবহেলা। সেদিন না-দেখেই বিমান অবতরণের ঝুঁকি না নিলে, এমন প্রাণহানির সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে। 

শুরু থেকেই সবিস্তারে বলা যাক ঘটনাটা। রাশিয়ার একাটেরিনবার্গ থেকে ২০ অক্টোবর উড়ান দিয়েছিল যাত্রীবাহী এরোফ্লট বিমান ৬৫০২। গন্তব্য ছিল গ্রজনি। সেদিন ককপিটে পাইলটের আসনে ছিলেন আলেকজান্ডার ক্লিউয়েভ। আর সহ-পাইলট হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জেনাডি জিনরোভ। দুই বিমানচালকের মধ্যে হালকা চালে তর্কযুদ্ধ শুরু হয় আকাশপথেই। বিমানচালক হিসাবে কে কতটা দক্ষ, তা নিয়েই তর্কের সূত্রপাত। ফার্স্ট অফিসার হওয়ার যোগ্যতা প্রমাণ করতেই তাই গুরুতর সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেন ক্লিউয়েভ। হ্যাঁ, শুধুমাত্র যন্ত্রের ওপর নির্ভর করে দৃষ্টিরুদ্ধ অবস্থাতেই বিমান অবতরণ করবেন তিনি। এমনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ক্লিউয়েভ। তবে তিনি যে সত্যি সত্যিই এমনটা করতে চলেছেন তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্যান্য ক্রু-দের। 

ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন দুপুর ৩টে বেজে ৪৮ মিনিট তখন। হাতে আর অবতরণের জন্য ঠিক মিনিট দুয়েক বাকি। বিমানের অবস্থান তখন মাটি থেকে ১৩০০ ফুট। এমন সময় ককপিটের সমস্ত পর্দা ফেলে দিতে নির্দেশ দিলেন ক্লিউয়েভ। এমন আদেশ শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন বিমান ইঞ্জিনিয়ার। খানিক প্রতিবাদের চেষ্টায় করেন তিনি। কিন্তু তাতে লাভ হল না কিছু। ক্যাপটেনের আদেশ অমান্য করলে যে ভয়ঙ্কর শাস্তির মুখাপেক্ষা হতে হবে তাঁকে। ফলত বাধ্য হয়েই পর্দা নামিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা! কিন্তু ক্যাপটেনকে বিন্দুমাত্রও বাধা দিলেন না সহকারী পাইলট। 

অবতরণ তো দূরের কথা। দৃষ্টিরুদ্ধ হওয়ার পর থেকেই বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিলেন ক্লিউয়েভ। বিষয়টি প্রথম নজরে আসে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের আধিকারিকদের। তাঁরাই লক্ষ করেন, মাটি থেকে বিমানের উচ্চতা যে হারে কমছে, সেভাবে কমেনি বিমানের গতিবেগ। তবে তখনও পর্যন্ত তাঁরা কেউ-ই জানেন না কী ঘটে চলেছে ককপিটের ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গেই টেলি সংযোগে সতর্ক করা হল দুই পাইলটকে। কিন্তু জেদ চেপে ধরেছে তখন তাঁদের। বাজি হারতে নারাজ দু’জনেই। কিন্তু বার বার সতর্কতার পরেও, সেদিন ক্রমাগত আশ্বাসবাণীই আউড়ে গিয়েছিলেন ক্লিউয়েভ। প্রতিবারই তাঁর উত্তর ছিল সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে। এমনকি যাত্রীদের সতর্ক করতে আদেশ দেওয়া হলেও, তিনি ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারকে ঘোষণা করতে দেননি দুর্ঘটনার পূর্বাভাস। 

অবশ্য শেষ মুহূর্তে ভুল বুঝতে পেরেছিলেন ক্লিয়েভ। পর্দা সরানোরও আদেশ দেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। ককপিটের পর্দা সরানোর পর এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে রানওয়ে স্পর্শ করে বিমানের চাকা। গতিবেগ তখন প্রতি ঘণ্টায় ২৮০ মাইল। টাল সামলানো সম্ভব হয়নি আর। মাটিতে ছুঁতেই লাফিয়ে ওঠে গোটা বিমানটি। উল্টে যায় রানওয়ের ওপর। তারপর খানিকটা ঘষড়াতে ঘষড়াতে যাওয়ার পরেই বিস্ফোরণ। 

ক্রু এবং যাত্রী— সব মিলিয়ে মোট ৮৬ জন মানুষ ছিলেন ফ্লাইট ৬৫০২-তে। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৫৮ জন। হাসপাতালে মৃত্যু হয় আরও ১২ জনের। এমন ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক কাজে বাধা না দিলেও, উদ্ধারকার্যে সবার প্রথমে সামিল হয়েছিলেন সহ-চালক জিনরোভ। ১১ জনের প্রাণ রক্ষা করেছিলেন তিনি। তবে হাসপাতালে যাওয়ার পথে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান নিজেই। এই নৃশংস ঘটনার দায় যে কুরে কুরে খাচ্ছিল তাঁকে ভেতর থেকে। আর ক্লিউয়েভ? আহত না হলেও, দুর্ঘটনার পর যাত্রীদের প্রাণ বাঁচানোয় কোনো পদক্ষেপই নেননি তিনি।

দেশের আন্তর্জতিক ভাবমূর্তি রক্ষার্থে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই আসল ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়েছিল সোভিয়েতের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি। এমনকি কোনো সংবাদপত্রকেই প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি ছবি। তবে বিমানবন্দরের এক কর্মচারী গোপনে বেশ কয়েকটি ফটোগ্রাফ সংগ্রহ করেন বিধ্বস্ত বিমানটি। দুর্ঘটনার প্রায় দু’দশক পরে প্রকাশ্যে এসেছিল সেই ছবিগুলি। 

আর ক্লিউয়েভ? প্রাথমিকভাবে বিচারে ১৫ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। তবে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভাঙার ঠিক পরের বছরই ছাড়া পেয়ে যান তিনি। পুনরায় কাজেও যোন দেন ক্লিউয়েভ। শুধুমাত্র যোগ্য বিচার থেকে বঞ্চিত থেকে যায় ফ্লাইট ৬৫০২-এর যাত্রীরাই…

Powered by Froala Editor