দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে হারানোর তালিকা। আবারও শোকের ছায়া নামল আন্তর্জাতিক সিনেমা-জগতে। চলে গেলেন আন্তর্জাতিক নানান পুরস্কারপ্রাপ্ত দক্ষিণ কোরিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা কিম কি-দুক। কোভিড১৯-এ আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্টের জটিলতায় শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত দেড়টা নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কোরিয়ার স্থানীয় সংবাদপত্রের দাবি অনুযায়ী লাটভিয়ার এক হাসপাতালেই মৃত্যু হয় তাঁর। বয়স হয়েছিল মাত্র ৬০ বছর।
বেশ কিছুদিন ধরেই বাল্টিক দেশে রেসিডেন্সি পার্মিট পাওয়ার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন কিম কি-দুক। রিগার সমদ্র উপকূলবর্তী জুরমালায় একটি রিসর্ট কেনার জন্যই গত ২০ নভেম্বর লাটভিয়ায় গিয়েছিলেন তিনি। তবে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি জরুরী সম্মেলনেও তাঁর হদিশ না পাওয়ায় অনুসন্ধান শুরু করেন তাঁর সহকর্মীরা। পরে জানা যায়, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে তিনি ভর্তি ছিলেন লাটভিয়ার এক হাসপাতালে। সুরক্ষার কারণেই গোপন করা হয়েছিল সমস্ত তথ্য। রিগা পরিচালক ভিটালি ম্যানস্কি এদিন তাঁর মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করেন।
কিম কি-দুকের জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ার উত্তর গেয়োংসাং প্রদেশে ১৯৬০ সালের ২০ ডিসেম্বর। ছোট্ট পার্বত্য শহর বোঙ্ঘোয়াতে বেড়ে ওঠা তাঁর। মাত্র ৯ বছর বয়সেই সেখান থেকে চলে আসা সেওলে। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রকে দেখেছেন খুব সামনে থেকে। অভাব-অনটন ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। নতুন শহরে এসে সেইভাবে সুযোগ হল না পড়াশোনারও। বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। স্কুল ছেড়ে কাজ শুরু করলেন এক কারখানায়। পরিবার-পরিজনের মুখে যে অন্ন সংস্থান করতে হবে তাঁকে।
তবে সেই চাকরিও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তারপর বছর কুড়ি বয়সেই দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন কিম। পরবর্তীকালে কোরিয়ার সীমান্তবর্তী একটি গির্জার সুরক্ষায় কর্মরত ছিলেন তিনি। সেখানে অন্ধ সন্ন্যাসীদের তত্ত্বাবধানের কাজে নিযুক্ত হন কিম। ধর্মে অবিশ্বাসী কিমকে ধীরে ধীরে আস্থিক করে তুলেছিল গির্জার পরিবেশ। পড়াশোনা করেছিলেন ধর্মপ্রচার নিয়েও। তবে শেষ হয়নি সেই পাঠক্রমও।
১৯৯০ সালে ৩০ বছর বয়সে তিনি পড়তে যান প্যারিসে। ফাইন আর্টস নিয়ে স্নাতকতা শেষ করে প্রবেশ করেন সিনেমার জগতে। কেরিয়ার শুরু হয়েছিল সামান্য এক স্ক্রিনরাইটার হিসাবে। সেখানেও খুব একটা সুযোগ মেলেনি। লড়াই করেই ছিনিয়ে নিতে হয়েছিল নিজের জায়গা। ১৯৯৫ সালে কোরিয়ান ফিল্ম কাউন্সিলের ‘সিনারিও কন্টেস্ট’-এ প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। আর তারপরেই বদলে যায় গোটা পটভূমিই। বেশ কয়েকবছর ধরেই যে ইচ্ছে বুনেছিলেন কিম মনে মনে, তাতে শিলমোহর চাপান প্রযোজক। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৈরি প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ‘ক্রোক্রোডাইল’। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
পূর্ব-এশিয়ার অন্যতম চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কথা উঠলে বারবারই উঠে আসে কিম কি-দুকের নাম। তাঁর হাত ধরেই বিশ্ব সিনেমা জগত পেয়েছে দ্য আইসেল, ৩-আয়রন, রিয়্যাল ফিকশন, ওয়াইল্ড অ্যানিম্যাল, পিয়েতা, সিক্রেট ইউনিয়ন, সামারিটান গারল, মেড ইন চায়না’র মতো উল্লেখ্যযোগ্য চলচ্চিত্র। সব মিলিয়ে ৩৩টি সিনেমা পরিচালিত করেছিলেন কিম।
আরও পড়ুন
ভারতীয় নৃত্যশৈলীতে এনেছিলেন আধুনিকতার ছোঁয়া, প্রয়াত কিংবদন্তি শিল্পী আস্তাদ দেবু
২০০৪ সালে সামারিটান গার্ল এবং ৩-আয়রন এই দুই সিনেমার জন্য এসেছিল জোড়া পুরস্কার। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের সিলভার বিয়ার এবং ভেনিসে সিলভার লায়ন পেয়েছিলেন কিম কি-দুক। আরিরাং সিনেমার জন্য পেয়েছিলেন কান চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা পরিচালকের সম্মাননা। তাছাড়াও ৬৯ ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে অন্যতম গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার তাঁর হাতে উঠেছিল ২০১২ সালে পিয়েতা সিনেমার জন্য।
তবে চলচ্চিত্র এবং ব্যক্তিগত জীবনে বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন তিনি। সিনেমার ক্ষেত্রে নান্দনিকতাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য কখনোই আপস করেননি কিম কি-দুক। বরং চরম ঘৃণ্য এবং নৃশংস দৃশ্যের ছবি হুবহু তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন চিরকাল। কঠিন বাস্তবকে বারবার প্রতিফলিত করেছেন সিনেমার পর্দায়। মার্কিন এক সাংবাদিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেছিলেন, ‘আমাদের দৈনিক জীবনে প্রতিদিনই খাদ্যের জন্য হত্যা করা হচ্ছে বহু প্রাণীকে। মার্কিন প্রদেশেও চল রয়েছে বিফ, চিকেন কিংবা পর্কের। তবে শুধুমাত্র সিনেমাতেই এই ঘটনা তুলে ধরলে বিরোধ কেন? এটাই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম। দুটির মধ্যে কোনো পার্থক্যই আমি লক্ষ্য করি না। সুতরাং এই ধরণের দৃশ্য ভবিষ্যতেও থাকবে আমার সিনেমায়।’
পরবর্তীকালে আরও এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি জানিয়েছিলেন দ্য আইসেল সিনেমায় নৃশংসভাবে হত্যা করা মাছগুলিকে ফিল্ম সেটে খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। যা নিয়ে ২০০০ সালে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল বিশ্বজুড়ে। কিমের বিরুদ্ধে অ্যানিম্যাল ক্রুয়েলিটির মামলাও করেছিলেন অনেকে। পাশাপাশি ২০১৭ সালে ময়বিয়াস ছবি নির্মাণের সময় সিনেমার নায়িকা শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন
নির্বাসন থেকে ফিরেই বিশ্বজয়, প্রয়াত ইতালির কিংবদন্তি ফুটবলার পাওলো রোসি
তবে একাধিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার সত্ত্বেও তাঁর তৈরি সিনেমা তৈরি করে দিয়েছিল এক আলাদা ‘আইডেনটিটি’। দক্ষিণ কোরিয়াকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের মানচিত্রে জায়গা করে দিয়েছিলেন তিনি। সময় পেয়েছেন মাত্র আড়াই দশক। আর এই ছোট্ট সময়ের ব্যবধানকেই তিনি কাজে লাগিয়েছেন সম্পূর্ণভাবে। উপহার দিয়েছেন একের পর এক মাস্টারপিস। কিম কি-দুকের মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হল কোরিয়ান সিনেমার সেই স্বর্ণযুগ। শেষ হল একটি দীর্ঘ অধ্যায়...
Powered by Froala Editor