৬ ও ৯ আগস্ট, ১৯৪৫। পরমাণু বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল জাপানের দুটি শহর— হিরোশিমা এবং নাগাসাকি। সেই প্রথম, সেই শেষ। তারপর আর দ্বিতীয়বার কোনো যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়নি পরমাণু বোমা। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের মধ্যে পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষার ইঁদুর দৌড় চলেছিল বেশ কয়েক দশক ধরে। পরবর্তীতে দুই দেশের মধ্যেই স্বাক্ষরিত হয় শান্তি চুক্তি। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্রের অস্ত্রভাণ্ডার কমিয়ে আনার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ— এই দুই মহাশক্তি। তারপর কেটে গেছে আরও তিন দশক। কিন্তু এই মারণাস্ত্রকে পরিত্যক্ত করেনি কোনো পক্ষই। অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া কিংবা ইজরায়েলের মতো দেশও তৈরি করেছে পারমাণবিক বোমা।
তবে মজার বিষয় হল, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইজরায়েলের বহু আগেই নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র (Atomic Weapon) বিকাশ করেছিল আরও একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশ— দক্ষিণ আফ্রিকা (South Africa)। নামটা শুনে খানিক ভ্রূ-কুঞ্চিত হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দেশের তালিকায় নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না দক্ষিণ আফ্রিকার। পাশাপাশি গোটা আফ্রিকান মহাদেশই গৃহযুদ্ধ, অনাহার কিংবা দুর্ভিক্ষের মতো সমস্যায় ধুঁকেছে নব্বই-এর দশক পর্যন্ত। সেক্ষেত্রে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির মতো পরিকাঠামো কিংবা রসদ কোথা থেকে পেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা?
উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে ষাটের দশকে। তখন গোটা বিশ্বজুড়েই চলছে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। অন্যদিকে তৎকালীন সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতায় ন্যাশনাল পার্টির সরকার। কমিউনিস্ট বিরোধী এই দলের শাসকরা শ্বেতাঙ্গ ছিলেন প্রায় সকলেই। স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েতকে ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরুতেই যোগ দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যেই ১৯৬৫ সালে সে-দেশে বসানো হয় প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। জ্বালানি অর্থাৎ ইউরেনিয়াম সরবরাহের দায়িত্ব নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার এই ঘনিষ্ঠতাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি সোভিয়েত। বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিবেশী দেশগুলিতে তখন ক্রমশ প্রভাব বাড়ছে কমিউনিজমের। ফলে, আগামীতে সোভিয়েত মদতপুষ্ট রাষ্ট্রেরা দক্ষিণ আফ্রিকায় হানা দিতে পারে, সেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতাশালী নেতৃত্বদের মধ্যে। সেখান থেকেই সূচনা পারমাণবিক অস্ত্র বিকাশ প্রকল্পের।
সর্বপ্রথম বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে ১৯৬৮ সাল। বিশ্বের একাধিক দেশ স্বাক্ষর করলেও, ননপ্রলিফারেশন ট্রিটি বা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার বিরোধী চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে দক্ষিণ আফ্রিকা। এর বছর দুয়েক পরই, ১৯৭০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকান সরকার ঘোষণা করে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্পকে। যদিও এই প্রকল্প কয়েক বছর আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল বলেই দাবি করেছিলেন সে-যুগের যুদ্ধবিশেষজ্ঞরা। যাই হোক, এর বছর খানেকের মধ্যেই পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের অনুমোদন দেন দক্ষিণ আফ্রিকার খনিজ ও জ্বালানি মন্ত্রী এফ ডব্লু ক্লার্ক। প্রকাশ্যে আসে, ইতিমধ্যেই পরমাণু বোমার প্রোটোটাইপ তৈরি করে ফেলেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
১৯৭১-১৯৭৯— এই আট বছরের মধ্যেই সবমিলিয়ে ৬টি পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা করেছিল আফ্রিকার দেশটি। ১৯৭৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা সামিল হয় পরমাণু শক্তিধর দেশের তালিকায়। সে-সময় তাদের অস্ত্রভাণ্ডারে মজুত ছিল ৭টি পরমাণু বোমা। প্রতিটিই ছিল হিরোশিমা ক্লাসের। অর্থাৎ জাপানে বিস্ফোরিত হওয়া পরমাণু বোমার সমপরিমাণ শক্তিশালী।
এবার নজর দেওয়া যাক দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। একদিকে যখন পরমাণু যুদ্ধের জন্য এই প্রস্তুতি চালাচ্ছে সে-দেশের শ্বেতাঙ্গ সরকার, তখন গোটা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বর্ণবিদ্বেষ বিরোধী আন্দোলন। নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে অধিকারের জন্য সরব হয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গরাও। বিশেষত ৮০-র দশকে ক্রমশ মাত্রা বাড়তে থাকে এই প্রতিবাদের।
এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে, দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসেন এফ ডব্লু ক্লার্ক। ১৯৮৯ সাল সেটা। প্রেসিডেন্টের আসনে বসার পরই এক আশ্চর্য ঘোষণা করেছিলেন ক্লার্ক। জানিয়েছিলেন নিজেদের সমস্ত নিউক্লিয় অস্ত্রের অস্তিত্ব মুছে ফেলবে দক্ষিণ আফ্রিকা। এমনকি ‘ক্লাসিফায়েড’ এই গবেষণার সমস্ত নথিও ধ্বংস করে দেবে সরকার। কিন্তু এমন আশ্চর্য ঘোষণার কারণ কী?
আসলে, ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডাযুদ্ধের ইতি পড়ে সোভিয়েত পতনের মাধ্যমে। অন্যদিকে বিশ্বে শান্তিস্থাপনের জন্য এনপিটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করাকেই প্রধান লক্ষ হিসাবে উপস্থিত করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে এই ঘটনার কারণ ছিল আরও গভীর। আসলে, দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন পরিস্থিতি নিশ্চিত করে দিয়েছিল, দেশের ক্ষমতায় আর কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসবে বিরোধী পক্ষ অর্থাৎ নেলসন ম্যান্ডেলার সরকার। মূলত কৃষ্ণাঙ্গরাই হবেন এই সরকারের চালক। কাজেই ক্ষমতা বদলের পর যে পারমাণবিক অস্ত্রের দাবিদার হয়ে উঠবেন তাঁরা। কৃষ্ণাঙ্গদের হাতে এই ক্ষমতা চলে আসুক— এমনটা স্বপ্নেও চাননি ক্লার্ক। আর সেই কারণেই পারমাণবিক অস্ত্রের গোটা প্রকল্পকে সমাধিস্থ করেন তিনি। উল্লেখ্য, বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসাবে পারমাণবিক অস্ত্র পরিত্যাগের এই নজির রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার ঝুলিতেই।
ক্লার্কের সন্দেহ যে মিথ্যে ছিল এমনটা নয়। ১৯৯২ সালে ক্ষমতায় আসেন ম্যান্ডেলা। ততদিনে পরমাণু শক্তিধরের তকমা হারিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। তারপর তিন দশক কেটে গেলেও আর নতুন করে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথে দ্বিতীয়বারের জন্য হাঁটেনি আফ্রিকার দেশটি। অন্যদিকে তৎকালীন সময় শান্তি স্থাপনে একাধিক খেতাব পান প্রাক্তন দক্ষিণ আফ্রিকান প্রেসিডেন্ট ক্লার্কের এই উদ্যোগ। অথচ, পশ্চিমের দুনিয়া উপেক্ষা করে গিয়েছিল বর্ণবাদের মতো একটি গূঢ় বিষয়কে…
Powered by Froala Editor