“শ্যুটিং সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের নোটবুক, পোস্টার, বুকলেট, পত্রিকা তো বটেই ওঁর করা একাধিক কাহিনিচিত্র, তথ্যচিত্র এবং টেলিচিত্রের ডিজিটাল কপিও থাকছে। থাকছে ২০০৭-২০১৩ সালের মধ্যে নেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকার এবং আলোকচিত্র প্রশিক্ষণ অডিও-ভিডিও সংগ্রহ। যা চলচ্চিত্রপ্রেমী যে-কোনো মানুষ, বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অমূল্য সম্পদ।”
বলছিলেন উত্তরপাড়ার ‘জীবনস্মৃতি আর্কাইভ’-এর (Jibansmriti Archive) কর্ণধার অরিন্দম সাহা সরদার। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল ৮টা বছর। গত ৮ তারিখ, ২৪ বৈশাখ, নবম বর্ষে পা দিল উত্তরপাড়ার এই আশ্চর্য সংগ্রহশালা। আর সেই উপলক্ষেই কবি নজরুল ইসলাম, সরোদশিল্পী পণ্ডিত যতীন ভট্টাচার্য এবং মৃণাল সেনের সংগ্রহশালার পর এবার ‘জীবনস্মৃতি’-তে খুলল আরও এক নতুন বিভাগ ‘সৌম্যেন্দু-সিন্দুক’।
হ্যাঁ, আলোকচিত্রী সৌম্যেন্দু রায়ের (Soumendu Roy) সিনেমা-যাপনকে কেন্দ্র করেই এই বিশেষ বিভাগ। যাঁরা বাংলা চলচ্চিত্রের অন্দরমহল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, তাঁরা এই নামটির সঙ্গে পরিচিত না-হলেও, চলচ্চিত্রপ্রেমী ও চলচ্চিত্রের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে সৌম্যেন্দু রায় এক অভিভাবক। সত্যজিৎ রায় তো বটেই, তপন সিংহ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, তরুণ মজুমদার, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী প্রমুখ খ্যাতনামা পরিচালকদের ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফারের ভূমিকা পালন করেছেন সৌম্যেন্দু। দেশ-বিদেশের নানান চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলা সিনেমার প্রতিনিধিত্ব করেছে তাঁর কাজ। এমন এক ব্যক্তিত্বের কর্মজীবন, দর্শন ও কাজ বৃহত্তর দর্শকমহলের কাছে পৌঁছে দিতেই গড়ে তোলা এই আর্কাইভ। ৮ তারিখ চিত্রশিল্পী হিরণ মিত্র এবং আলোকচিত্রী আদিনাথ দাসের হাত ধরেই পথ চলা শুরু হয় এই সংগ্রহশালার।
তবে শুধু সৌম্যেন্দু রায়ের সংগ্রহশালাই নয়, একইসঙ্গে ২৫ বৈশাখ, রবীন্দ্রজয়ন্তীতে নতুন করে সেজে উঠল ‘জীবনস্মৃতি’-র ‘মৃণাল সেন’ (Mrinal Sen) বিভাগ ‘মৃণাল মঞ্জুষা’-ও। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী এবং মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এদিন জীবনস্মৃতি আর্কাইভে আয়োজিত হয়েছিল বিশেষ অনুষ্ঠান। হাজির ছিলেন মৃণাল সেনের পুত্র কুণাল সেন এবং পুত্রবধূ নিশা রুপারেল সেন। সন্ধ্যাপ্রদীপ প্রজ্বলন এবং বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বিশেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয় রবীন্দ্রনাথ ও মৃণাল সেনকে।
গত বছর ১৪ মে, মৃণাল সেনের জন্মদিনে উদ্বোধন হয়েছিল ‘জীবনস্মৃতি আর্কাইভের’-র ‘মৃণাল মঞ্জুষা’ বিভাগটি। সংরক্ষিত হয়েছিল মৃণাল সেনের একাধিক ছবির ডিজিটাল পোস্টার, সিনেমার ডিজিটাল কপি, সাক্ষাৎকার ও দুষ্প্রাপ্য নানান স্থিরচিত্র ও নথি। এবার আরও কিছু দুষ্প্রাপ্য পোস্টার, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত মৃণাল সেনের লেখা, চলচ্চিত্রভাবনা এবং বিশ্লেষণ জায়গা পেল এই আর্কাইভে।
কথায় কথায় উঠে এল ‘ভুবন সোম’-এর প্রসঙ্গ। অরিন্দমবাবু জানালেন, “এই ছবির প্রথম ডিস্ট্রিবিউটার ছিল প্রিয়া সিনেমা। ওরাই সে-সময় এই ছবির পোস্টার তৈরি করে। সেই পোস্টার কালের আবহেই হারিয়ে গেছে। পরে মুম্বাই-এর রাজশ্রী সিনেমা ভুবন সোমের ডিস্ট্রিবিউটর হয়। সেখান থেকে প্রকাশিত হয়েছিল দুটি পোস্টার। একটি বেশ কয়েকদিন আগেই হাতে পেয়েছিলাম আমরা। অন্যটি ৯ তারিখ ডাক-মারফত মুম্বাই থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছায়। দুষ্প্রাপ্য পোস্টারটির মোড়ক উন্মোচন করেন কুণাল সেন।” তাছাড়াও ‘পরশুরাম’ ছবির একটি দুষ্প্রাপ্য পোস্টারও পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ করা হয়েছে জীবনস্মৃতিতে।
২০১১ সাল থেকে মৃণাল সেনকে নিয়ে বিশেষ তথ্যচিত্র তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন অরিন্দম। সেইসূত্রে মৃণাল সেন তো বটেই, তাঁর আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তিনি। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের পাশাপাশি যে-সকল গণসংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন মৃণাল, তাদের সাক্ষাৎকার ও স্মৃতিচারণও ধরা পড়েছিল অরিন্দমের ক্যামেরায়। তাঁর কথায়, “মৃণাল সেনের সিনেমা তো রয়েছেই। সেইসঙ্গে ব্যক্তি পরিসরে মৃণাল সেন কেমন মানুষ ছিলেন, এইসব সাক্ষাৎকার থেকে তা সহজেই আন্দাজ পাওয়া যায়।” সবমিলিয়ে প্রায় ৭০জন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির থেকে নেওয়া এই সাক্ষাৎকারের পুরো সংগ্রহটিই অডিও-ভিজ্যুয়াল ফর্ম্যাটে এবার প্রত্যক্ষ করা যাবে ‘জীবনস্মৃতি’ আর্কাইভে। সিনেমাপ্রেমী মানুষ এবং চলচ্চিত্র-গবেষকদের জন্য এই সংগ্রহ আক্ষরিক অর্থেই ‘অরূপ রতন’।
Powered by Froala Editor