হিটলার-বিরোধিতার শাস্তি, গিলোটিনে প্রাণ হারালেন কিশোরী সোফি

হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। মাথা রাখা গিলোটিনের বেদিতে। এবার শুধু বলি হওয়ার অপেক্ষা। তবে দস্যি মেয়েকে দমেনি মৃত্যুর প্রাক-মুহূর্তেও। দৃপ্ত কণ্ঠস্বর খানিকটা আক্ষেপের সঙ্গেই বলে উঠল, ‘এই রোদ ঝলমলে দিনেই যেতে হবে আমাকে! তবে আমার মৃত্যু যদি কয়েক হাজার মানুষের ঘুম ভাঙাতে পারে, তবে আপত্তি নেই’। সোফি শোল। না, গোটা বিশ্বের কাছে নামটা খুব একটা পরিচিত নয় ঠিকই। তবে জার্মানিতে প্রতিবাদের অন্যতম প্রতীক তিনি। গত পরশু তাঁর একশো বছর জন্মবার্ষিকী পালিত হল জার্মানি জুড়ে। সেইসঙ্গে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশেষ মুদ্রা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিল জার্মান মিন্ট।

বয়স তখন মাত্র ২২ বছর। জীবন দিতে হবে জেনেও হিটলারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন সোফি। সরব হয়েছিলেন মানবাধিকার, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার দাবিতে। ইহুদি না হয়েও পিছপা হননি নাৎসি সরকারের বিরোধিতা করতে। 

১৯২১ সালের ৯ মে ফোরচেনবার্গ শহরে জন্ম সোফির। বাবা ছিলেন এই শহরেরই মেয়র। তবে কিশোর বয়সেই এই শহর ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৩৩ সালে ফোরচেনবার্গ ছেড়ে উলমে চলে যায় তাঁর পরিবার। জার্মানি জুড়ে তখন এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। মাথা চাড়া দিচ্ছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। তারপরই নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এলেন অ্যাডলফ হিটলার। 

আর পাঁচজন জার্মান নাগরিকদের মতো সুদিনের স্বপ্ন দেখেছিলেন সোফির বাবা রবার্টও। এমনকি সোফি নিজে এবং তাঁর ভাই হান্স যোগ দিয়েছিলেন হিটলারের যুব-আন্দোলনে। ‘দ্য লিগ অফ জার্মানি গার্লস’-এর সদস্যাও ছিলেন কিশোরী সোফি। তবে ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি খুব একটা। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার আগেই সোফি বুঝে ওঠেন, ক্রমশ একনায়কতন্ত্রের দিকেই হাঁটছে তাঁর দেশ। 

১৯৩৫ সাল, জার্মানিতে লাগু হল নুরেমবার্গ আইন। কোণঠাসা করে দেওয়া হল ইহুদিদের। তাঁদের নিষিদ্ধ করা হল শহরের বিভিন্ন অংশ এবং সরকারি কার্যালয় থেকে। সেই সূত্রেই ‘লিগ অফ জার্মানি গার্লস’ থেকে বাদ পড়েন তাঁর দুই সহপাঠী। সোফি তখন স্কোয়াড লিডার। ঊর্ধ্বস্তরে অভিযোগ বর্ণবাদের অভিযোগ জানালেন তিনি। কিন্তু গোটা পরিকাঠামোই যে পক্ষপাতদুষ্ট। কাজ হল না কোনো। ফলত, বিকল্প পথ বেছে নিলেন তিনি। সংগঠনের মধ্যেই প্রকাশ্যে পাঠ করলেন ইহুদি কবি হেনরিক হাইনের কবিতা। পরিণাম শাস্তি। কেড়ে নেওয়া হল অধিনায়কত্ব।

তবে তখনও পর্যন্ত তাঁর আস্থা রয়েছে হিটলারের সরকারে। তবে সেই ধারণা ভেঙে গেল জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের পরেই। নাৎসি সংগঠন তো ছাড়লেনই পাশাপাশি প্রকাশ্যে বিরোধীতা করলেন হিটলারের। সৈনিকদের জীবনের ঝুঁকি জেনেও, অযথা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করছেন হিটলার। এই ছিল তাঁর অভিযোগ। এই যুদ্ধ যে মিথ্যে দেশপ্রেম; তা জন্মভূমির জন্য নয়, সেকথা বার বার ফিরে এসেছে তাঁর লেখা চিঠিতে, ডায়েরিতে।

সক্রিয় হিটলার বিরোধী আন্দোলনের জড়িয়ে পরা আরও কয়েক বছর পর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময়ে। সোফি তখন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রী। ভাই হান্স এবং আরও চার সহপাঠীদের নিয়ে তৈরি করলেন ছোট্ট একটি সংগঠন। ‘হোয়াইট রোজ’। যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির বাতাবরণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই লক্ষ্য। তরুণ-তরুণীদের এই উদোগের কথা জানতে পেরে এগিয়ে এলেন অধ্যাপক কার্ট হুবারও। শুরু হল ইহুদি হত্যা এবং যুদ্ধবিরোধী প্রচার। গোপনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এবং শহরে লিফলেট ছড়াতে শুরু করল সোফিদের হাত ধরেই। 

১৯৪৩ সালে ছাপানো হয় ‘হোয়াইট রোজ’-এর ষষ্ঠ প্যামফ্লেট। দিনটা ছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদ থেকে বৃষ্টির মতো নেমে এলো অজস্র লিফলেট। ছড়িয়ে পড়ল গোটা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। এই লিফলেট কুড়োতেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রীতিমতো ভিড় জমে গেল ছাত্রছাত্রীদের। উত্তেজিত হয়ে ছাদের রেলিং-এ ঝুঁকে এই ভিড় দেখছিলেন সোফি। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। তবে সাড়া পাচ্ছে তাঁদের উদ্যোগ? কিছু মানুষের কাছে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হচ্ছেন তাঁরা? এও যেন এক অপার তৃপ্তি। 

এই মুহূর্তই যে তাঁর শমন হয়ে দাঁড়াবে কে জানত। বিষয়টি ধরা পরে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তত্ত্বাবধায়কের চোখে। জার্মান গোয়েন্দা সংস্থা গেস্টাপোতে খবর পৌঁছে দেন তিনি। গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ চলে সোফি এবং তাঁর ভাইয়ের। হাজার অত্যাচারেও সহকর্মীদের কথা প্রকাশ্যে আনেননি হান্স ও সোফি। বিচারে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয় দু’জনকেই। তার আর মাস খানেকের মধ্যেই পুলিশ খুঁজে বার করে বাকিদেরও। প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় সবার দেহ।  

সোফি শোল এবং ‘হোয়াইট রোজ’ সংগঠনের ইতিহাসের ওপর পরবর্তীকালে লেখা হয়েছে একাধিক উপন্যাস নাটক। তৈরি হয়েছে সিনেমাও। নাৎসি জার্মানির পতনের পর সোফি এবং হান্স দু’জনের নামেই নামকরণ হয়েছে রাস্তার। তৈরি হয়েছে স্কুলও। যুদ্ধের এত এত বছর পেরিয়ে এসেও আজ সে-দেশে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক বছর বাইশের অকুতোভয় তরুণী। গোটা জার্মানি জুড়ে বর্তমানে আবার নতুন করে ফিরছে নাৎসিবাদ। সংগঠন বড়ো করছে চরম দক্ষিণপন্থী দল এএফডি। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বৈষম্যহীন জার্মানির স্বপ্ন দেখাতে, সোফির বিকল্প আর কে-ই বা হতে পারে?

Powered by Froala Editor