ফুংসুক ওয়াংড়ু-র কথা মনে আছে? বড্ড কঠিন হয়ে গেল? বেশ। র্যাঞ্চো? এবার নিশ্চয়ই চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। হ্যাঁ, থ্রি ইডিয়টস সিনেমার সেই কেন্দ্রীয় চরিত্রের কথাই বলছি। তবে সিনেমার এই চরিত্র নির্মিত হয়েছিল বাস্তবের ওপর ভিত্তি করেই। তিনি আর কেউ নন, লাদাখের প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষাবিদ, উদ্ভাবক ও গবেষক সোনাম ওয়াংচুক। সম্প্রতি আরও একবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন প্রখ্যাত এই গবেষক। ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য সৌরশক্তি চালিত উষ্ণতা নিয়ন্ত্রক তাঁবু তৈরি করে তাক লাগালেন তিনি।
লাদাখের হিমশীতল আবহাওয়াতেও তাঁর এই তাঁবু ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা ধরে রাখতে সক্ষম। পাশাপাশি উত্তপ্ত করার জন্য কেরোসিন, কাঠ বা অন্যান্য জ্বালানির প্রয়োজন না হওয়ায়, সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব এই তাঁবু। অন্যদিকে ভয় নেই অগ্নিকাণ্ডেরও। পাশাপাশি এই তাঁবু সম্পূর্ণ বহনযোগ্য এবং একটি তাঁবুতে থাকতে পারবেন সর্বোচ্চ দশজন সেনা। ওজনও ৩০ কেজির মধ্যে। সম্প্রতি তিনি নিজের ট্যুইটার হ্যান্ডেলে এই তাঁবুর প্রোটোটাইপের সম্পর্কে দু-চার কথা লিখে পোস্ট করেন ছবি। আর তারপরই তা ভাইরাল হয়ে যায় নেট দুনিয়ায়।
লাদাখের লে জেলায় ১৯৬৬ সালে জন্ম সোনাম ওয়াংচুকের। স্কুলের পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয় ৯ বছর বয়সে। লে-র দুর্গম পরিবেশে কোনো স্কুল না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষা নেন বাড়িতেই। মাতৃভাষায়। পরে শ্রীনগরের একটি স্কুলে ভর্তি হন তিনি। তবে মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভাষা। নতুন শহর, নতুন ভাষার সঙ্গে জুত করে নিতে পারেননি তিনি। অবশেষে সকলের অজান্তেই স্কুল থেকে পালিয়ে দিল্লি চলে যান একাই। বয়স তখন মাত্র ১১ বছর। দিল্লিতেই কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পরবর্তীকালে পড়াশোনা করেছেন সোনাম ওয়াংচুক।
তবে স্কুলজীবনের পর নিজের পড়াশোনার খরচ বহন করতে হয়েছে নিজেকেই। কেননা, বাবার অমতে গিয়ে তিনি বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন প্রযুক্তিবিদ্যাকে। তবে অর্থাভাব কি দমাতে পারে প্রতিভাকে? মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে শ্রীনগর এনআইটি থেকে স্নাতকতা করেন ওয়াংচুক। তারপর আর্থেন আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করতে বিদেশযাত্রা। ফ্রান্স।
আরও পড়ুন
দুই শতকে এই প্রথম, গবেষকদের আবিষ্কৃত নীল রঙের নতুন শেড এল বাজারে
পড়াশোনা শেষ করে লাদাখে ছাত্র শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেইসঙ্গে চলতে থাকে নিত্যনতুন গবেষণা, আবিষ্কারও। লক্ষ্য ছিল লাদাখের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষাব্যবস্থার পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া। ভারত সরকারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে লাদাখে শেষ অবধি শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে তাঁর ‘অপারেশন নিউ হোপ’ মিশন। ২০০৫ সালে ভারতের জাতীয় শিক্ষা পরিষদে উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ করা হয় তাঁকে।
তবে তাঁর বিচরণ শুধু শিক্ষাক্ষেত্র কিংবা গবেষণাতেই সীমাবদ্ধ নয়। লাদাখের একমাত্র ছাপা পত্রিকা ‘লাদাগস মেলং’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তিনিই। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে এসেছে এই পত্রিকা। তুলে ধরেছে লাদাখের সংস্কৃতিকে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে ভারতের দুর্গম এই উপত্যকার।
আরও পড়ুন
রামানুজন-গ্রাফ সমাধান করে ‘মাইকেল অ্যান্ড শিলা হোল্ড পুরস্কার’ জয়ী ভারতীয় গবেষক
লাদাখের সেকমল ক্যাম্পাসের নকশাও তাঁর তৈরি করা। গোটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিই চলে সৌরশক্তিতে। আলো, উত্তাপ এমনকি রান্নার কাজেও ব্যবহৃত হয় সৌরশক্তি। আর সবটাই তাঁর উদ্ভাবনী। ২০১৪ সালে আরও একটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প নিয়েছিলেন ওয়াংচুক। কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করেছিলেন হিমবাহ। যা দেড় লক্ষ লিটার জল ধরে রাখতে সক্ষম বরফের আকারে। সফলভাবে এই ধরণের দুটি ‘আইস স্তুপা’ তৈরিও করেছেন ওয়াংচুক।
তাঁর সাম্প্রতিক নকশাকৃত এই সৌর-উত্তপ্ত তাঁবু সম্প্রতি ভাইরাল হলেও, এই ধরণের আরও একটি কাজ করেছিলেন তিনি প্রায় এক দশক আগে। চাংথাং অঞ্চলে বসবাসকারী যাযাবর সম্প্রদায়ের জন্য বানিয়েছিলেন এমনই বহনযোগ্য সোলার প্যাসিভ হাউস। যা তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারত পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। এই তাঁবু ব্যবহারের জন্য সরকারের কাছেও প্রোটোটাইপ জমা দিয়েছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে তা আর বিতরণ করা হয়নি।
আরও পড়ুন
খুলবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর নতুন দিগন্ত, যুগান্তকারী আবিষ্কার বাঙালি গবেষকের
সেই প্রযুক্তিতেই বেশ কিছু বদল এনে সাম্প্রতিক তাঁবু তৈরি করেছেন সোনাম। এই তাঁবুর আস্তরণের মধ্যেই রয়েছে সৌরশক্তি সঞ্চয় করার প্রযুক্তি। প্রতি তাঁবু পিছু তৈরিতে খরচ পড়বে আনুমানিক ৫ লক্ষ টাকা। আপাতত লাদাখে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্যই বানানো হচ্ছে এই সোলার টেন্ট। তবে পর্যটকদের জন্যও আগামীদিনে বেশ জনপ্রিয়তা পেতে পারে বলেই মনে করছেন লাদাখের এই বিজ্ঞানী। আর তেমনটা বাস্তবায়িত হলে নিয়ন্ত্রণে আসবে প্লাস্টিক দূষণও। এক কথায় এই আবিষ্কার যেন একই সঙ্গে সমাধান খুঁজে দিচ্ছে একাধিক সমস্যার…
Powered by Froala Editor