‘ভারতবর্ষের আইন অনুযায়ী একজন যৌনকর্মীকে বাড়ি ভাড়া দেওয়া অপরাধ। সুতরাং ভোটার কার্ডের প্রশ্নই ওঠে না।'
বলছিলেন স্মরজিৎ জানা। ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির' প্রতিষ্ঠাতা। আসলে, সোনাগাছির যৌনকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে লড়ে আসছেন তাঁদের ভোটাধিকারের দাবিতে। নানা রাজনৈতিক দল মসনদে এসেছে। কিন্তু সমস্যার সুরাহা হয়নি কোনোদিনই।
২০০৪-এর আগে যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তিরই ভোটার কার্ড ছিল না। ইলেকশন কমিনশনের সঙ্গে চলছিল আইনি যুদ্ধ। ভোট-বয়কট কিংবা নোটা, প্রতিবাদের নানা পন্থাই বেছে নিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু বিধি বাম। এর কারণ, ভারতবর্ষে যৌনপেশাকে একটি পেশা বলেই স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। সদা লেগে থাকে ফড়ে-দালাল এবং পুলিশের নজর। অতএব...
পশ্চিমবঙ্গে বেজে গিয়েছে ভোটের দামামা। রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নিজ নিজ কেন্দ্রে প্রচারের শেষ পর্বে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইস্তেহারে ফিরে এসেছে প্রান্তিক মানুষদের দাবিদাওয়া। তাঁদের জন্য নানা প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি। যেমন সংযুক্ত মোর্চা তাদের মিছিলে সামনে রাখছে, এলজিবিটিকিউএআই কমিউনিটির প্রতিনিধিদের। কিন্তু এর মধ্যেই চলছে অন্য এক আন্দোলন। রাজনৈতিক দলগুলির চোখের অগোচরেই।
আরও পড়ুন
যৌনকর্মীরাও ‘কর্মরতা মহিলা’, ঘোষণার দাবি মানবাধিকার কমিশনের
বাংলার যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন লড়ছে দুর্বার। তবে এই নির্বাচনেই তারা ছিনিয়ে এনেছে এক ঐতিহাসিক জয়। হ্যাঁ, এবার ভোট দিতে পারবেন তাঁরা। কীভাবে এই অসম্ভব সম্ভব হল?
আরও পড়ুন
১৫০ বছর আগের কলকাতায় যৌনরোগ, সংক্রমণ রুখতে যৌনকর্মীদের ওপর অত্যাচার শুরু
উত্তরটা হয়তো দুটি শব্দে রয়েছে, উষা কো-অপারেটিভ। হ্যাঁ। এই সমবায়ের মাধ্যমেই ভোট দিতে পারছেন যৌনকর্মীরা। ২০০৪ সালে দুর্বারের উদ্যোগে সোনাগাছিদের বাসিন্দাদের নিয়ে খোলা হয়েছিল এটি। এর আগে স্থায়ী ঠিকানা, ও স্বীকৃত পেশা না থাকার কারণে সরকারি নথিতে একরকম বেনাগরিক ছিলেন তাঁরা। ২০০৪-এর পর কমবেশি সকলেই সরকারি খাতায় যোগ হন সমবায়-সদস্য হিসেবে। কো-অপারেটিভের পাসবই-এর মাধ্যমে ভোটার কার্ডও হাতে পেয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু লাল-ফিতের ফাঁসে আটকে ছিল অনেকেরই গণতান্ত্রিক অধিকার।
লকডাউন চলাকালীন যৌনপেশা পড়েছিল সংকটের মুখে। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সোনাগাছির বাসিন্দাদের রুটি রুজি। এগিয়ে আসে দুর্বার। স্মরজিৎবাবুর কথায়, “গতবছর সুপ্রিম কোর্টে আমরা একটি রিস্ক পিটিশন দাখিল করেছিলাম, লকডাউনে যৌনকর্মীদের খোরপোশের আবেদন করে। ছিল, ফুড কুপন বা রেশন কার্ডের দাবি।" সেই সময়েই শুরু হয় সকলের নাম নতুনভাবে নথিভুক্ত করা। তার ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছে ভোটার আই-কার্ড। এমনকি নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিরা এলাকায় ঘুরে অবশিষ্ট সকলেরই তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাঁদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এবার প্রত্যেকেই পারবেন ইভিএমের বোতামে চাপ দিতে।
তবে এমন খুশির খবরের মধ্যেও সিঁদুরে মেঘ দেখছেন স্মরজিৎবাবু। তাঁর কথায়, “লালবাতি এলাকায় ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট গুণ্ডা। এবং কয়েকজন পুলিশকর্মীও জড়িত এই চক্রে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় তারা নানাভাবে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে…"
শীঘ্রই এ-বিষয়টি নিয়ে কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসছে দুর্বার। তবে এসবের পরেও, এই যে স্বীকৃতি ছিনিয়ে আনলেন তাঁরা, তা ঐতিহাসিক হয়ে রইল। নতুন দিনের সূচনা কিনা, তা অবশ্য সময়ই বলবে...
Powered by Froala Editor