ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের 'অর্জুন’

“শত্রুকে চেনো, অগ্নিময় ক্রোধে উহাদের মুখোস টানিয়া ছিঁড়িয়া ফেলো। উহারাই দেশের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করিয়াছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভিটামাটি হইতে উচ্ছন্ন করিয়া আশ্রয়প্রার্থী ভিখারিতে পরিণত করিয়াছে—আর আজ ক্রূরতম স্পর্ধায় সকল মানুষের প্রিয় গান্ধীজিকেও হত্যা করিয়াছে। আগামীকাল সমস্ত দেশকে হত্যা করিবে।”

১৯৪৮ সালের ৩১ জানুয়ারি ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার ‘সম্পাদকীয়’-তে বেরোল এই জ্বালাময়ী লেখা। লেখকের নাম সোমনাথ লাহিড়ী (Somnath Lahiri)। ‘স্বাধীনতা’ তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (Communist Party of India) মুখপত্র। ঠিক তার আগের দিনই নাথুরাম গডসের গুলিতে মারা গেছেন গান্ধীজি। স্বাধীনতার আস্বাদ তিক্ত। দেশভাগের হাত ধরে এসেছে উদ্বাস্তু পরিস্থিতি। সোমনাথ লাহিড়ীর লেখায় ধরা পড়ল গত এক-দেড় বছরের ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র রাগ। সম্পাদকীয়-র শিরোনামও ছিল ‘শোক নয়, ক্রোধ’। 

তার কদিনের মাথাতেই কমিউনিস্ট পার্টি ঘোষণা করে ‘ঝুটা স্বাধীনতা’-র নীতি। নিষিদ্ধ করা হয় পার্টিকে। আত্মগোপনে যান দলের নেতারা। এই নীতির পূর্বাভাসই কি ছিল সোমনাথ লাহিড়ীর লেখায়? অথচ, ইতিহাসের উলটো পিঠেই লেখা আছে, ভারতের সংবিধান রচনার গণপরিষদে তিনিই ছিলেন একমাত্র কমিউনিস্ট সদস্য। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নাকি তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থান? কমিউনিস্ট পার্টি, তার নেতৃত্ব, এমনকি পার্টি মুখাপেক্ষী সাহিত্য বিশ্লেষণেও তিনি ছিলেন নিরপেক্ষ আদর্শবাদী।

১৯০৯ সালে তাঁর জন্ম। মাত্র ১৯ বছর বয়সে সংস্পর্শে আসেন বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের। যোগ দেন করাচি অধিবেশনে। তখন একদিকে লবণ সত্যাগ্রহ, অন্যদিকে দিল্লির আইনসভায় ভগৎ সিং-রা বোম ফাটালেন। মুখে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’-এর স্লোগান। গান্ধীজির পথ সম্পূর্ণ মানতে পারলেন না তিনি। প্রকাশ করলেন ‘অভিযান’ নামের একটি পত্রিকা। ততদিনে পড়েছেন বামপন্থী বইপত্র। সেই পথেই চালিত করবেন পত্রিকাটিকে। অথচ বামপন্থী বলতে একমাত্র চেনেন ভূপেন্দ্রনাথকে। তিনি শুধু লেখা দিলেন না, ঠিক করে দিলেন ভবিষ্যতের নিশানা। ছটি সংখ্যার পর অবশ্য উঠে যায় ‘অভিযান’।

আরও পড়ুন
অনিল বিশ্বাস : বঙ্গ রাজনীতির চাণক্য

১৯৩১-এর জুলাইতে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘সাম্যবাদ’ প্রকাশিত হওয়া মাত্রই বইটি বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ সরকার। ওই বছরই গড়ে তোলেন ই বি রেলওয়ে শ্রমিকদের ইউনিয়ন। যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতেও। ভূপেন্দ্রনাথ ঘনিষ্ঠ বলে পার্টির আদিসদস্য, বিশেষ করে মুজফফর আহমেদ-এর সঙ্গে খানিক দূরত্বও ছিল। পার্টি অফিস তখন জাকারিয়া স্ট্রিটে। সদস্যও হাতে গোনা। দলাদলি ছিল তাঁদের মধ্যেও, এমনকি মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় জেলবন্দি কমিউনিস্টদের মধ্যেও।

আরও পড়ুন
প্রধানমন্ত্রী হলে, 'শ্রেষ্ঠ' হতেন তিনিই? প্রণব মুখোপাধ্যায় ও পাঁচ দশকের রাজনীতি

ফলে সেই সময়ে কলকাতায় তাঁদের কাজের দায়িত্ব প্রচুর। ১৯৩২-এ সারা ভারত শ্রমিক সংগঠনের সভার বচসায় সুভাষচন্দ্রের সঙ্গ দিয়েছেন। ‘রাষ্ট্র ও আবর্তন’ নামে অনুবাদ করেছেন লেনিনের ‘দ্য স্টেট অ্যান্ড রেভলিউশন’ গ্রন্থটি। যদিও গ্রন্থটির প্রথমে নাম ছিল ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’। কিন্তু ‘বিপ্লব’ শব্দটির জন্য বাজেয়াপ্ত হওয়ার ভয়ে পিছিয়ে যান অনেক প্রকাশক। 

কমিউনিস্ট পার্টি তখন গা বাঁচিয়ে চলছে সশস্ত্র আন্দোলন থেকে। তা সত্ত্বেও মিথ্যা মামলায় ধরা পড়ে যান সরোজ মুখোপাধ্যায়, হরেকৃষ্ণ কোঙার-রা। পুলিশের সঙ্গে রীতিমতো তর্ক জুড়ে দেন সোমনাথ লাহিড়ী। সামনেই দলের সর্বভারতীয় সম্মেলন। এই অবস্থায় পুলিশি ঝামেলা এড়াতে চেয়েছিলেন তাঁরা। ছাড়া পান কদিন পরেই। আব্দুল হালিম, রণেন সেনদের সঙ্গে সম্মেলনে তিনিও প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলার হয়ে। পার্টির আদি পর্বের কলকাতা কমিটির অন্যতম সদস্য হন। ১৯৩৪ সালে জামশেদপুরে চলে যান ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়ে। সেখানে মার খান গুন্ডাদের হাতে। পুলিশ গ্রেপ্তারও করে। এসব তখন প্রায় গা-সওয়া।

পরবর্তীতে তেভাগার সময়, পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার সময় কাজে লেগেছে জীবনের এই অধ্যায়গুলি। ১৯৬৪-তে কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙনের পর থেকে যান পুরনো সিপিআই-তেই। জড়িয়ে পড়েন মতান্তর আর মনান্তরের রাজনীতিতে। ১৯৬৭-তে যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর কিছুদিন মন্ত্রীও ছিলেন। বিধানসভার সদস্য ছিলেন দীর্ঘদিন। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার আসার পর সরে যান সবকিছু থেকে। পার্টির আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে কি দেখেছিলেন চিরকালীন ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত ঔদ্ধত্য? বিশ্বাস হারিয়েছিলেন বামপন্থী সরকারের প্রতি? পরবর্তীর বিভিন্ন কথাবার্তায় কিন্তু তার প্রমাণ রয়েছে।

ফলে সোমনাথ লাহিড়ীকে জানতে গেলে রাজনীতিই একমাত্র মাপকাঠি নয়। জুড়ে দিতে তাঁর সাহিত্যচর্চার জীবনকেও। সম্পাদক ছিলেন ‘কালান্তর’ ও ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার। ‘কলিযুগের গল্প’ নামে রয়েছে একটি ছোটগল্পের সংকলন। একই সঙ্গে ছিল সাহিত্য সম্পর্কে অত্যন্ত স্বচ্ছ ধারণা। স্বাধীনতার পরপরই শিল্পের উপর পার্টি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বেশ উত্তপ্ত বাদানুবাদ হয়েছিল বামপন্থী সাহিত্যমহলে। অনেকেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন পার্টি-কর্তৃত্বের তত্ত্ব। ‘বিপ্লব’-এর স্লোগানসর্বস্ব হয়ে উঠেছিল সাহিত্য। সোমনাথ লাহিড়ী কিন্তু তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন এইসব হুজুগের। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপাল হালদার তো বটেই; যাঁকে তিনি ‘স্বাধীনতা’-য় লেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, সেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও রেহাই পাননি তাঁর সমালোচনার হাত থেকে।

১৯৮৪-তে মৃত্যুর পরদিন ‘কালান্তর’ পত্রিকা লিখেছিল, “ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অর্জুন এতদিনে তাঁর গাণ্ডীব রাখলেন।” বহুমুখীন ঘটনায় বিস্তৃত ছিল জীবন। স্পষ্ট ছিল মতাদর্শ। বামপন্থার ব্যক্তিগত সংজ্ঞায় বিশ্বস্ত ছিলেন আজীবন। মতের বহু পক্ষে থাকতে পারে মানুষ। রাজনীতির সমান্তরালে চলতে থাকে মানুষ হয়ে ওঠার অভ্যাস। আর তাই জীবনের কাছে ঋজু থাকার শক্তি অর্জন করাও একটা অনুশীলন, দীর্ঘ অনুশীলন...

তথ্যঋণ:
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও আমরা, সরোজ মুখোপাধ্যায়
বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন দলিল ও প্রাসঙ্গিক তথ্য, দ্বিতীয় খণ্ড
৯ আগস্টের এক বছর, সোমনাথ লাহিড়ী
অপূর্ব রায়, আচমন পত্রিকা

Powered by Froala Editor