ট্রামের শহর কলকাতা, কথাটা বললে হয়তো খুব একটা ভুল হবে না। আজকাল অবশ্য ব্যস্ত ট্রাফিকের মধ্যে শ্লথ গতির ট্রামকে অনেকেই জগদ্দল পাথর মনে করছেন, অনেকের কাছে আবার তা এক ঐতিহ্য। অন্তত ট্রাম বাদ দিয়ে কলকাতার কথা ভাবা যায় না। আর এই বাহনটিকে ঘিরে গল্পও তো কম নেই। সেই ১৮৭৩ সালে শিয়ালদা স্টেশন থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত যাত্রা শুরু। তারপর লাইনের উপর দিয়ে কত ট্রাম চলে গিয়েছে, ঘোড়ায় টানা গাড়ির পরিবর্তে এসেছে বৈদ্যুতিন ট্রাম। এখন তো আবার শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাম চলে রাস্তায়। কিন্তু এর মধ্যে কি গল্পগুলো কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে? ইতিহাসের কতটা খোঁজ রাখি আমরা?
ঘোড়ায় টানা গাড়ি হিসাবেই ট্রামের যাত্রা শুরু। এই তথ্য আমরা সবাই জানি। তারপর এসেছে বৈদ্যুতিন ট্রাম। তবে এর মাঝে একসময় স্টিম ইঞ্জিনে টানা ট্রামের সাক্ষী থেকেছে কলকাতা। সেটা ১৮৮২ সালে। প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে একমাসের জন্য এই গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আর এই একমাসের মধ্যেই ৬টি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে বাষ্পচালিত ট্রাম। এখনকার দিনে হলে তৎক্ষণাৎ এই গাড়ি বেআইনি ঘোষণা করার কথা উঠত। কিন্তু সেদিনের কথা ছিল আলাদা। দুর্ঘটনা ঘটেছে তো কী হয়েছে? মানুষ তো মারা যায়নি। অতএব জনগণের ইচ্ছায় কর্তৃপক্ষ আরও ১১ মাস সময়সীমা বাড়িয়ে দিল। তারপর অবশ্য আবার ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালু হয়। শুধু প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সময় কালীঘাটের তীর্থযাত্রীদের জন্য এই ট্রাম চালানো হত। বৈদ্যুতিন ট্রাম আসে তার অনেক পর, ১৯১০ সালে।
কলকাতার ট্রাম অবশ্য যাত্রী পরিবহনের জন্য চালু হয়নি। উদ্দেশ্য ছিল মালপত্র পরিবহন করা। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই এই গাড়িতে যাত্রীদের প্রবল ভিড়। প্রথম দিন, অর্থাৎ ১৮৭৩ সালের ২৪ এপ্রিল; সেদিনের ঘটনা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। সেদিন শিয়ালদা স্টেশন থেকে দুটি গাড়ি ছেড়েছিল। প্রথমটিতে ভিড় হয়েছিল বেশ। তবে দ্বিতীয়টিতে আরও বেশি। দুটি তাগড়াই ঘোড়া মিলে কিছুতেই টানতে পারে না সেই গাড়ি। বারবার চাবুক মারা হয় তাদের। কিন্তু গাড়ি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই থাকল। একচুল নড়ল না।
তবে মালপত্র বা যাত্রী পরিবহন ছাড়াও আরেকটি কাজ ছিল ট্রামের। এখনও মাঝে মাঝে এক ধরনের সবুজ ট্রাম রাস্তায় দেখা যায়। তার বেসমেন্টে এক বিশেষ ধরনের জলের পাইপ লাগানো থাকে। গাড়ি রাস্তায় চললেই জল ছিটাতে ছিটাতে যায়। আর এভাবেই দীর্ঘদিন কলকাতার রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করেছে ট্রাম। বর্তমানে নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোতে এরকম পাঁচটি এককামরার সবুজ ট্রাম রাখা আছে।
কলকাতার ঐতিহ্য ট্রাম। তার ইতিহাস প্রায় ১৫০ বছর হতে চলল। আর প্রতি পরতে পরতে জড়িয়ে আছে এমন কত গল্প, কত ইতিহাস। ট্রামকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মঞ্চও উত্তাল হয়েছে। পঞ্চাশের দশকে কলকাতার ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনের জেরে ছুটে আসতে হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকেও। ট্রাম বাঙালির কাছে বড়ো নিজের জিনিস। তাই তো অন্যান্য শহরে এই ধীর গতির গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলেও কলকাতার রাস্তায় এখনও চলছে। আর তাতে যাত্রীর সংখ্যাও তো নেহাত কম নয়।
তথ্যসূত্র: কলিকাতা দর্পণ, রাধারমণ মিত্র
রাস্তা ধোয়ার ট্রামগাড়ী!, কলকাতার 'সাতকাহন'
Powered by Froala Editor