একটিবার দেখতে আসুন 'গুরু' শীর্ষেন্দু, চেয়েছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী হুমায়ূন আহমেদ

“একবার শিলং-এ বেড়াতে গিয়েছি। সুনীল আর শক্তিও ছিল। সে দিন ওদের মদ খেয়ে হঠাৎ কী যে হল! দুজনেই আমার প্রবল প্রশ্বস্তি আরম্ভ করে দিল। “আপনার মতো ভালো লেখক কেউ নেই”- এই ধরনের কথাবার্তা। আমি তো প্রবল অস্বস্তিতে পড়লাম। সারাক্ষণ এই বলে গেল দুজনে! কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না ওদের!”

একটি সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। পূজাবার্ষিকী বেরোলে আজও বাঙালি যার লেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এতদিনের অভ্যাস, এত সহজে কি মোছা যায়! নানা রূপে আমাদের সামনে এসেছেন তিনি। কখনও ‘শবর’ হয়ে, কখনও ‘ঘুণপোকা’র শ্যাম হয়ে হাজির হয়েছেন। আর অদ্ভুতুড়ে? তাকেই বা কেমন করে ভোলা যায়! সবদিক দিয়ে শীর্ষেন্দু রয়েছেন আমাদের। একটা ছেলেবেলা জুড়ে আছে তাঁকে ঘিরে; জড়িয়ে আছে নতুন শারদীয়ার গন্ধ… 

তাঁর জীবনটাও তো কত গলি, রাজপথ ঘুরে হাজির হয়েছে সামনে। ময়মনসিংহের মানুষ তিনি; খোলা জল হাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন। হঠাৎই গেল সবটা বদলে। দেশভাগ আর কাঁটাতার একান্নবর্তী মুখোপাধ্যায় পরিবারকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল। ‘উজান’ বেয়ে বারবার ফিরে। যেতে চেয়েছেন সেই বাড়িটার কাছে, সেই পুরনো সময়। স্মৃতি সতত সুখের, আবার দুঃখেরও। সেই উজানের ভেতরেই নৌকা চালিয়ে এসেছেন শীর্ষেন্দু। আজও তার অন্যথা নেই। 

যে সময়টায় লেখার জগতে আগমন, তখন বাংলার পরিবেশ উত্তাল। ‘এ বড়ো সুখের সময় নয়’। রাস্তায় রাস্তায় পুড়ছে বাস, নকশাল আন্দোলনের ঢেউ গ্রাম ছাপিয়ে চলে এসেছে শহরেও। কোনদিনও সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকেননি শীর্ষেন্দু। বরং সেই ভিড় এড়িয়েই চলেছেন। কিন্তু সময় বড়ো অমোঘ বস্তু। আর একজন লেখক তাঁর কলমে সেই সময়কেই ধরার চেষ্টা করেন। স্বাভাবিক নিয়মে নকশাল আন্দোলনও ছুঁয়ে গিয়েছিল তাঁকে। ‘শ্যাওলা’, ‘দূরবীন’-এর মতো উপন্যাসের পাতায় দেখা গেছে তার ছোঁয়া। ‘দূরবীন’-এর ধ্রুব একজন রাগী, বদমেজাজি ছেলে। প্রায় সেভাবেই তাঁকে দেখতে এবং দেখাতে চেয়েছেন শীর্ষেন্দু। কীসের প্রতি বিরক্ত সে? সমাজ? প্রশাসন? সংসার, বা নিজের প্রতি? জানা নেই। অথচ শীর্ষেন্দু’র সেই ‘খল’ চরিত্রই জনপ্রিয়তা পেল সবার মধ্যে। কেন হল এমন? অবাক হন লেখক। আরও বেশি করে মানুষের মনের মধ্যে ডুব দেন। ধ্রুব’র কোনো অচেনা দিকের সন্ধান কি পাওয়া যাবে সেখানে? 

আরও পড়ুন
প্রবল অর্থাভাব, তবু ছাড়বেন না বাংলা; বম্বের ডাক ফেরালেন ‘চিত্রনাট্যকার’ তারাশঙ্কর

পূর্ব বাংলার মাটিতেই জীবন শুরু হয়েছিল। একটা সময় সেই মাটি ছাড়তে হলেও, লেখার সূত্রে যেন যোগসূত্র তৈরি হয়ে গেছে বাংলাদেশের সঙ্গে। সেই ঢেউয়েই হাজির হয়েছিলেন আরও একজন লেখক— হুমায়ুন আহমেদ। একবার ঢাকায় গেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। সেখানকার এক প্রকাশকের সঙ্গে গাড়ি করে বেরিয়েছিলেন কাজে। হঠাৎই সেই প্রকাশক বললেন, তিনি শীর্ষেন্দুকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চান। কোথায়? কিছুতেই বলতে চাইলেন না তিনি। এদিকে শীর্ষেন্দুও অধৈর্য হয়ে পড়ছেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, গাড়ি থেমেছে একটি বাড়ির সামনে। আর তার গেটে… হ্যাঁ, ঠিক চিনেছেন! হুমায়ূন আহমেদ! যে করেই হোক, ‘গুরু’ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করবেনই তিনি। তাই এমন আয়োজন…

এপার হোক বা ওপার, সাহিত্যের আঙিনায় হুমায়ূন আহমেদের অবদানও যে অস্বীকার করা যায় না। আজও আমরা ‘হিমু’ হতে পারিনি, কিন্তু সেই স্বপ্ন তো দেখিয়েছিলেন তিনি! সেই হুমায়ুন আহমেদ প্রেরণা পেতেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখার হাত ধরে। ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ কে না যেতে চায়! মনে পড়ে শেষের এই দিনের কথা। হুমায়ূন তখন আমেরিকায়, ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছেন। ঘটনাচক্রে, তখন একটি কাজে আমেরিকায় গিয়েছিলেন শীর্ষেন্দুও। নিউ ইয়র্কে এসে শুনলেন, হুমায়ূন আহমেদ হাসপাতালে ভর্তি। শীর্ষেন্দু যেন একটিবার আসেন তাঁকে দেখতে, এই তাঁর ইচ্ছা। দুটো কথা বলবেন ‘গুরু’র সঙ্গে। কিন্তু শীর্ষেন্দু’র তো পরেরদিনই সকালে ফ্লাইট। সেইবার যেতে পারলেন না তিনি। আফসোস, আর দেখা হয়নি হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে… 

আরও পড়ুন
‘ঘর নেই জমি নেই পেটে নেই ভাত’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতায় ফুটে ওঠে আজকের পরিস্থিতিই

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যে সময়ে লেখার জগতে এসেছিলেন, প্রায় একই সময় এসেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়রা। তাঁদের ছিল বেপরোয়া জীবন, ‘মধ্যরাতে কলকাতা শাসন’ করার স্পর্ধা। সেই সারণিতে কিছুটা আলাদা শীর্ষেন্দু। তাঁর জীবন এত বেপরোয়া ছিল না, মদ্যপানও করেননি; উল্টে ছিলেন ঘোর সংসারী। স্কুলে চাকরি করেছেন, ধর্মচিন্তা করেছেন, ঠাকুরের প্রতি অগাধ ভক্তি আজও। এই আবরণটুকুই যা আলাদা ছিল। জীবনযাপন ভিন্ন হলেও, বন্ধুত্বে তাঁর কোনো প্রভাব পড়েনি। দেখেছেন কমলকুমার মজুমদারকেও। কখনও বৈরিতা হয়নি? বা খারাপ কিছু লাগেনি? 

একটি সাক্ষাৎকারে ফিরে ফিরে এসেছে এই কথাই। সুনীলের ‘নীললোহিত’ময় যাপন থেকে সরে আসা, ক্রমাগত উচ্চশ্রেণীর মধ্যে চলে যাওয়া— এই সমস্ত কিছু ফিরে এসেছে সেখানে। তিনিও তো এখন জনপ্রিয় লেখক। এত গুণমুগ্ধ পাঠক তাঁর, ইচ্ছা করে না এসব জায়গায় যেতে? সটান বলেছেন, “এসব কিছু আমার কাছে খুব অপছন্দই ছিল।” আজও পায়ে হেঁটে বাজার করেন তিনি। অবসর পেলে কার্টুন দেখেন টিভিতে। একটা সাধারণ জীবনযাপনই বারবার চেয়েছেন শীর্ষেন্দু। সাধারণ না থাকলে, সাধারণের কষ্ট, জিজ্ঞাসা, চাওয়া, স্বপ্নগুলো কী করে বুঝবেন? তাঁকে ঘিরে কোনো স্তাবকের বলয় তৈরি হোক, চাননি সেটাও। সেজন্য ‘দেশ’ পত্রিকার গল্পের নির্বাচকের ভূমিকা পেলেও হেলায় ছেড়েছেন। তাহলে যে তরুণ লেখক ও পাঠকরা সর্বক্ষণ তাঁকে ঘিরে থাকবে! “সুনীলের এই বলয়টা ছিল। ও বলয়টাকে খুব পছন্দও করত। এটা আমার খুব অপছন্দ ছিল।”

আরও পড়ুন
যে অভয়ারণ্যে পাখির কলকাকলি, ত্রস্ত হরিণের সঙ্গে রয়েছেন বিভূতিভূষণও

বারবার এসেছে আত্মজীবনীর আহ্বান ও। কখনও কি লিখবেন নিজের কথা? জানা নেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের। ‘উজান’, ‘ঘুণপোকা’য় তো টুকরো টুকরো হয়ে ফিরে এসেছে তাঁর জীবন। সেটাই না হয় থাকল। শেষদিন পর্যন্ত নিজের লেখার কাছে, কলমের কাছে সৎ থাকতে চান। “গাদা গাদা চিঠি লিখলেই কেউ রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাবে না। মগজে কিছু থাকতে হবে।” তাই, এই ৮৫ বছর বয়সেও সাধনা জারি রইল তাঁর। কখনও বইয়ের পাতায়, কখনও সিনেমার পর্দায় অবতীর্ণ হবে তাঁর সৃষ্টি। আর শীর্ষেন্দু? তখন তিনি নাতনির সঙ্গে খেলায় ব্যস্ত। হয়ত মাথায় ঘুরবে নতুন কোনো দৃশ্য। রাত হলে ঘর থেকে শোনা যাবে পাতা আর কলমের খসখস শব্দ… 

তথ্যঋণ-
১) ‘শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকি আলাপ’, হাবীব ইমন, পরস্পর
২) ‘সবার পক্ষে লেখক হওয়া সম্ভব নয়’, অঞ্জন আচার্য, এনটিভি অনলাইন
৩) ‘তোষামুদেদের অপছন্দ করি বলেই আমায় ঘিরে কোনও বলয় নেই’, সুমন দে, আনন্দবাজার পত্রিকা
৪) ‘বন্ধুরা নেই, কিন্তু বন্ধুত্ব ঠিকই রয়ে গিয়েছে’, বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য, এনডিটিভি বাংলা

আরও পড়ুন
লেখালিখির টাকায় আস্ত দ্বীপ কিনেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ?

Powered by Froala Editor

More From Author See More