ভারসাম্যের খেলায় হার মানাতে পারে সার্কাসকেও; পৃথিবীর আশ্চর্য কিছু পাথর-যুগলের গল্প

/৭

দুটো পাথর একে অন্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুতভাবে! ছোটোখাটো নয়, বিশাল চেহারা তাদের। আর সেইভাবেই ব্যালেন্স করে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলেই মনে হবে ম্যাজিক; কেউ যেন নিপুণ হাতে সাজিয়ে রেখেছে তাদের। যেন একটু ছুঁলেই বিগড়ে যাবে পাথর দুটির ব্যালেন্স। আর সেখান থেকেই নাম ‘ব্যালেন্সিং রক’। পৃথিবী জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অদ্ভুত ভৌগোলিক নিদর্শনগুলির অন্যতম। ব্যালেন্সিং রকের সামনে দাঁড়ালে আমাদের বিস্ময় আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। এক, দুদিন নয়; বহু বছর ধরে বিশ্বের নানা জায়গায় এদের উপস্থিতি। ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গও তার বাইরে নেই। সেরকমই বেশ কিছু অদ্ভুত ব্যালেন্সিং রকের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক…

/৭

মামা-ভাগ্নে পাহাড় (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)— চারিদিকে সমতল লাল মাটির জঙ্গল; আর তার মধ্যেই হঠাৎ করে গজিয়ে উঠেছে বেশ কিছু বিশাল টিলা। এরকম বিচ্ছিন্ন পাথরের স্তূপ স্বাভাবিকভাবেই বিস্ময় তৈরি করে। আর তাদের মধ্যেই দুটি বিশেষ পাথরের দিকে নজর সবার। একটি বড়ো, অন্যটি তুলনামূলক ছোটো। একে অন্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুতভাবে। আর এরাই পরিচিত মামা-ভাগ্নে পাহাড় হিসেবে। বীরভূমের দুবরাজপুরের এই বিখ্যাত জায়গাটি ঘিরে তৈরি হয়েছে অজস্র মিথ। তখন রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে লঙ্কায় ফিরে গেছেন। সমুদ্রের ওপর সেতু বন্ধন করার জন্য যখন রামচন্দ্র হিমালয় থেকে পাথর নিয়ে আসছিলেন, তখন নাকি কয়েকটি পাথর বীরভূমের এই অঞ্চলে পড়ে যায়। এবং তারপরই তৈরি হয় মামা-ভাগ্নে পাহাড়। এরকম বিচ্ছিন্ন পাথরের স্তূপ দেখেই হয়তো এমন রূপকথার জন্ম হয়েছে। কেবল পর্যটনকেন্দ্র নয়; সিনেমার শুটিংয়ের জন্যও বিখ্যাত এই জায়গাটি।

/৭

কৃষ্ণের ‘মাখন-বল’ (তামিলনাড়ু, ভারত)— নাম দেখে খানিক আশ্চর্য লাগছে! অবাক হবেন না; তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরমে গেলে ঠিক এই জিনিসটিরই সম্মুখীন হবেন আপনারা। এবং তখনই অবাক হওয়ার পালা শুরু। পাথুরে জমির ওপর ঠাই দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশালাকার পাথর। দেখলে মনে হবে, এই একটু পরেই গড়িয়ে পড়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। বহু বছর ধরে এইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে মহাবলীপুরমের আশ্চর্য পাথর। যাকে বলে, ব্যালেন্সিং রকের আদর্শ উদাহরণ। পল্লবরাজ নরসিংহবর্মণের আমল থেকেই চেষ্টা চলছে পাথরটিকে সরানোর। কিন্তু হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও, এক চুলও নড়েনি এই পাথর। এর পিছনের রহস্য এখনও অধরা। আর তাই এখানেও তৈরি হয়েছে মিথ। শ্রীকৃষ্ণের অন্যতম প্রিয় খাদ্য ছিল মাখন। এখানেই নাকি ভুল করে খানিক মাখন ফেলে গিয়েছিলেন তিনি। আর সেটাই কালে কালে এই বিশাল পাথরের আকার নিয়েছে। মিথ হলেও, পাথরের সামনে দাঁড়ালে বুকটা একটু হলেও কাঁপবেই!

/৭

জব্বলপুরের ব্যালেন্সিং রক (মধ্যপ্রদেশ, ভারত)— মধ্যপ্রদেশের অন্যতম পর্যটনক্ষেত্র হল মদন মহল দুর্গ। প্রতি বছরই ভিড় লেগে থাকে। আর এই দুর্গের অনতিদূরেই রয়েছে এই বিস্ময়কর জিনিস। এমনিতেই চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা আকারের পাথর। তার মধ্যেই চোখ পড়বে এই ব্যালেন্সিং রকের দিকে। একটি বড়ো পাথরের বেসমেন্টের ওপর অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি বড়ো পাথর। একে অপরকে ছুঁয়ে থাকলেও সেই সংযোগস্থলের পরিসীমা খুবই কম, মাত্র ৬ বর্গইঞ্চি! এইটুকু জায়গায় বছরের পর বছর কী করে একটি পাথর এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে! বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে সরানোর, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। একের পর এক ভূমিকম্পও সহ্য করে এসেছে এরা। এতটুকুও ভারসাম্য নষ্ট হয়নি। পর্যটক তো বটেই, ভূ-বিজ্ঞানীরাও ঢুঁ মারেন এখানে।

/৭

কুম্মাকিভি (ফিনল্যান্ড)— দক্ষিণ ক্যারেলিয়ার রুওকোলাহটি। মূলত ঘন সবুজ জঙ্গল হিসেবেই পরিচিত এই অঞ্চল। আর সেখানে ঢুকলেই চোখে পড়বে এই পাথর। একদম নিচের পাথরটির আকার উঠের কুঁজের মতো। আর তার ওপরই দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটি পাথর। দেখে মনে হবে যেন সার্কাসের খেলা চলছে। বা কোনো দক্ষ ভাস্কর এই কাজটি গোপনে করে গেছেন। আসলে তা একেবারেই নয়। বহু বছর ধরেই এদের অবস্থান এই জায়গায়। যেন একটু ধাক্কা দিলেই পাথরটি গড়িয়ে পড়বে নিচে। আদতে এসব কিছুই হয়নি। ‘কুম্মাকিভি’ নামটির অর্থই হল ‘অদ্ভুত পাথর’। নামকরণ যে যথাযথ, সেটা একপ্রকার নিশ্চিত।

/৭

সাইবোটেক (পোল্যান্ড)— এতক্ষণ যা বলা হল, সেসবই ছিল দুটি পাথরের কীর্তি। এবারও একই ব্যালেন্সিং রক; তবে দুটি নয়, অনেকগুলি পাথর। পোল্যান্ডের জায়ান্ট মাউন্টেনেই রয়েছে এমন নিদর্শন। অনেকগুলো গ্রানাইট পাথর একে অপরের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। এবং প্রতিটাই নিজেদের ভারসাম্য বজায় রেখেছে। একদম ওপরের সবচেয়ে বড়ো পাথরটি দেখলেই এর বিশেষত্ব বোঝা যাবে। পোল্যান্ডের এই জায়গায় কেবল এই ব্যালেন্সিং রককে দেখার জন্যই অনেকে ভিড় করেন। একবার ঠেলে দেখতে চান, গড়িয়ে পড়ে কিনা!

/৭

চিরিকাহুয়া ন্যাশনাল মনুমেন্ট (অ্যারিজোনা)— বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাথুরে জমি। উঁচু উঁচু পাহাড়, সেইসঙ্গে রুক্ষ ভূপ্রকৃতি। আর এখানেই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ব্যালেন্সিং রক। একটা দুটো নয়, অনেকগুলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় গেলে আপনাকে যেতেই হবে এই জায়গায়। ভূ-বিজ্ঞানীদের কাছেও এই স্থানটির গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁদের মতে, একটা সময় বড়ো অগ্ন্যুৎপাতের ফলে এই গোটা অঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে। এবং ধীরে ধীরে ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে এই ব্যালেন্সিং রকগুলির সৃষ্টি হয়েছে। পর্যটকরা তো বটেই; অ্যাডভেঞ্চারের জন্যও এই জায়গাটি সবার পছন্দের।

Powered by Froala Editor

More From Author See More