সিকিম (Sikkim)—বাঙালির অন্যতম প্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সদালাপী মানুষের আতিথেয়তায় বছরের প্রতিটি সময় লেগে থাকে ভিড়। উত্তর সিকিমের লাচেং উপত্যকার কথা তো বলাই বাহুল্য! একপাশে তিস্তা (Teesta) নদীকে রেখে পাহাড়ের গা বেয়ে কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে বরফের দেশ ডাকে হাতছানি দিয়ে। চুংথাম (Chungthang) বাঁধের সন্ধ্যার মায়াবী আলোর অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তিতে দাঁড়াতে বাধ্য হতেন পর্যটকরা। অথচ আজ সেখানে শুধুই আতঙ্ক। রাতের অন্ধকারে শুধু শোনা যায় ‘রাক্ষুসী’ তিস্তার তীব্র গর্জন। প্রবল বন্যায় ভাসছে সিকিমের সমগ্র উত্তর আর পূর্বাঞ্চল। এত বড়ো বিপর্যয় কি সাম্প্রতিক সময়ে আর দেখেছে সে রাজ্যের মানুষ?
প্রাথমিকভাবে কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে উত্তর সিকিমের লোনাক হ্রদের (Lhonak Lake) উপর মেঘভাঙা বৃষ্টিকে। যার ফলে খুলে দিতে হয় চুংথাম বাঁধ। তিস্তার জলস্তর ১৫-২০ ফুট বেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সিকিমের বিভিন্ন অঞ্চলে। জলের তোড়ে ভেঙে গেছে দশ নম্বর জাতীয় সড়ক। ইতিমধ্যে খবর আসছে একাধিক মৃত্যুর। নিখোঁজ কুড়িজনেরও বেশি সেনা। বিপর্যস্ত সিকিমের সাধারণ মানুষ, আটকে রয়েছেন বাংলার বহু পর্যটকও।
সিকিমের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য প্রাকৃতিক কারণ নিঃসন্দেহে দায়ী। যার সঙ্গে লড়াই করার শক্তি আজও অর্জন করতে পারেনি মানুষ। বড়োজোর নেওয়া যেতে পারে পূর্বপ্রস্তুতি, কিংবা সচেতন হওয়া যায় আগের উদাহরণ থেকে। কিন্তু সেটাও কি হচ্ছে আদৌ? যোশীমঠের ভাঙন, কেদারনাথ, হিমাচল প্রদেশ আর সিকিমের বন্যা বিচ্ছিন্ন হয়েও কি একসুতোয় বাঁধা পড়ে যায় না? সিকিমের বিষয়টিই ধরা যাক। ‘গ্লোবাল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাডস’-এর (GLOF) ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংবেদনশীল লোনাক হ্রদটি। কেন? বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্রমাগত গলে যাচ্ছে দক্ষিণ লোনাক হিমবাহের (South Lhnokak Glacier) বরফ। হিমবাহ থেকে গলিত জলে বাড়ছিল লোনাক হ্রদের জলস্তর। সিকিমের জেমু হিমবাহ, রাথং হিমবাহ আর লোনাক হিমবাহ তিনটিই ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে। তাপমাত্রাও বেড়েছে সমানতালে। শুধু লোনাক নয়, হিন্দুকুশ হিমালয়ের একাধিক হিমবাহেই গত দশকের তুলনায় দ্রুত গতিতে গলছে বরফ।
২০১৩ সালে ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টারের রিপোর্টে স্পষ্ট দেখানো হয়েছিল, লোনাক হিমবাহ গত চল্লিশ বছরে কতটা পরিমাণ গলেছে এবং হ্রদের আকার কত দ্রুত বেড়ে চলেছে। যার অত্যন্ত স্বাভাবিক পরিণতি হবে মেঘভাঙা বৃষ্টি। হিমালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে চলতি বছরে সংসদেও পেশ করা হয় একটি রিপোর্ট। কাশ্মীর থেকে টানা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা আছে, স্বীকার করে নেওয়া হয় বিষয়টি। সত্তরটিরও বেশি হিমবাহের উপর রাখা হয়েছিল নজর। পাশাপাশি বছর কয়েক আগেই সিকিম সরকার লোনাক হ্রদে ‘হাই ডেনসিটি পলিইথিলিন পাইপ’ বসিয়েছিল অতিরিক্ত জল বের করে দেওয়ার জন্য। বিপদ মোকাবিলায় সেটা যথেষ্ট ছিল না, বর্তমান ঘটনা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন
সিকিমের 'গর্ব' তীর-ধনুককে বাঁচিয়ে রাখতে লড়াই বৃদ্ধের
সামনে রাখা যাক আরেকটি বিষয়। ইতিমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে সেবক-রংপো রেলপথের কাজ। ১৪টি টানেল আর ১৪টি বড়ো ব্রিজ পার করে দৃঢ় হবে দুই রাজ্যের বন্ধন। সম্ভবত পূর্ব সিকিমের নাথুলা সীমান্ত পর্যন্ত চলে যাওয়া যাবে ট্রেনে চেপে। চিন সীমান্তে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও পর্যবেক্ষণের কাজে যা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হতে চলেছে। ভালো খবর নিঃসন্দেহে। কিন্তু প্রকৃতিকে যথাযথভাবে বাঁচিয়ে কাজ চলছে তো? খাতায়-কলমে উত্তরটা ‘হ্যাঁ’ হতে বাধ্য। তাতেও প্রশ্ন থেকে যায় স্থানীয় গ্রামসভার অনুমতি বিষয়ে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এত ‘উন্নয়ন’ আবার একটা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে কিনা! যোশীমঠের উদাহরণ তো সামনেই রয়েছে।
আরও পড়ুন
ভারতের অন্তর্গত রাজ্য নয়, ১৯৭৫ পর্যন্ত সিকিমের পরিচয় ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই!
এ বছরেরই মার্চের কথা। উত্তর সিকিমেরই সোকপায় গ্রামে ধ্বস নেমে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২ কিলোমিটার সড়ক। ডিকচু-রাকডং রাস্তাটি উত্তর সিকিমের সঙ্গে গ্যাংটকের একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রতি বর্ষায় প্রায়ই ছোটোখাটো ধ্বস নামে সোকপায়। প্রকৃতি বিরূপ হলে কারোর কিছু করার নেই। কিন্তু স্থানীয়দের মতে তিস্তা নদীর উপর ‘এনএইচপিসি’ বাঁধটি তৈরির পর থেকে বেড়েছে ধ্বসের সংখ্যা। ২০০৮ সালে যখন জাতীয় হাইড্রোপাওয়ার কর্পোরেশন বাঁধটি নির্মাণ করে, তখন প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তাঁরা। স্বাভাবিকভাবেই কান দেওয়া হয়নি সেসবে। ফল যাই হোক না কেন, কারণটা বারবার কান ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছে নাকি?
আপাতত সুস্থ হয়ে উঠুক সিকিম। তিস্তার জলস্তর বৃদ্ধি মানে বিপদ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশেরও। আশা রাখা যায় যে, কোনো বড়োসড়ো সমস্যা আর ঘনিয়ে উঠবে না। একের পর এক বিপর্যয় দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে চোখ-মন। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দ্রুত ভুলতে চাইবে তার স্মৃতি। কিছুদিন পরেই হয়তো থেমে যাবে সমস্ত আলোচনা। বাতাসে কিন্তু প্রশ্নটা থেকে যাবে। “কত হাজার মরলে পড়ে মানবে তুমি শেষে, বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে?”
ঋণস্বীকার :
Climate change traces on lhonak glacier using geospatial tools, Jayant Nath Tripathi and others, Quaternary Science Advance
Sikkim at risk of devastating floods from glacial lake outbursts, Soma Basu, Down to Earth, February 2013
Glacial lake keeps disaster managers on toes in Sikkim, Jyoti Singh, Down to Earth, September 2018
Disaster of Devolopment? Why locals are up in arms against the Sikkim rail project, Gurvinder Singh, Scroll.in, September 2019
চিত্রঋণ : Government of Sikkim
Powered by Froala Editor