পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় স্বাধীনতা দিবস ১৫ নয়, ১৮ আগস্ট!

“At the stroke of the midnight hour, when the world sleeps, India will awake to life and freedom.” 

দিল্লিতে দাঁড়িয়ে নতুন স্বপ্নের কথা শোনালেন সদ্য প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসা জওহরলাল নেহরু। স্বপ্ন দেখতে শুরু করল একটা দেশ, দীর্ঘ ২০০ বছর যারা সংগ্রাম করে গেছে বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে। রক্তে ভিজে গেছে মাটি, জ্বলে গেছে ঘর; তবুও লড়ে গেছে তাঁরা। দাবি একটাই, স্বাধীনতার। ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭। এতদিনে তাঁদের লড়াই শেষ হল। এবার অন্য লড়াইয়ের সময়। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সময়। একটা দেশ হয়ে ওঠার সময়…

কিন্তু যতটা স্বপ্নের শুরু হওয়ার কথা ছিল, ততটা হল কি? ধর্মের ভিত্তিতে উঠল দেশভাগের তত্ত্ব। তারপর দাঙ্গা, রক্তপাত, খুন, বীভৎসতা, এবং শেষে গোটা দেশের ওপর দিয়ে চলে গেল র্যা ডক্লিফ সাহেবের ছুরি। তারপরের দীর্ঘ উদ্বাস্তু চিত্র আর তার বর্ণনা এবং বাংলার দুর্দশা বহুবার উঠে এসেছে নানা প্রতিবেদনে কিংবা গল্পে। সেইসঙ্গে আরও একটি জিনিস ঘটে গিয়েছিল। র্যা ডক্লিফ সাহেব তো নিজের মতো ম্যাপে লাইন টেনে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তান দুই ভাগ করে দিলেন। আর তারপরই দেখা গেল গণ্ডগোল। আর যার জন্য অবতারণা ১৮ আগস্টের। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী বেশ কিছু অঞ্চলের কাছে এই দিনটিই স্বাধীনতা দিবস; ১৫ আগস্ট নয়… 

স্বাধীনতার সেই সন্ধিক্ষণ, যার জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল এতদিন। অপেক্ষা করছিলেন নদিয়ার বাসিন্দারাও। উত্তেজনায় কেঁপে উঠছিলেন বনগাঁ, মুর্শিদাবাদ, রানাঘাট, বালুরঘাটের মানুষরাও। ঘোষণা হল বটে; কিন্তু এই সমস্ত জায়গায় নেমে এল স্তব্ধতা। তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তবর্তী আরও কিছু জায়গা আছে। ঘটনাটা হল, র্যা ডক্লিফের বানানো ম্যাপ অনুযায়ী নদিয়ার একটা বড়ো অংশ, বনগাঁ, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, কল্যাণী, শান্তিপুর, অন্যদিকে বালুরঘাট আর মুর্শিদাবাদেরও কিছু অংশ ভারতের বদলে চলে যায় পূর্ব পাকিস্তানে। 

আর তাতেই বাধে গণ্ডগোল। র্যা ডক্লিফ এই দেশের ধর্মীয় সমীকরণ নিয়ে বিশেষ কিছু জানতেন না; উপরন্তু সময়ও দেওয়া হয়নি দেশভাগের কাজে। কিন্তু সেসব যুক্তি তো এখন কাজে লাগবে না। এই সমস্ত অঞ্চলের মানুষরা বিদ্রোহ ঘোষণা করল। কিছুতেই পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁরা একাত্ম হবে না। তারা ভারতের অংশ ছিল, সেখানেই থাকবে। নদিয়ায় রানি জ্যোতির্ময়ী দেবীর নেতৃত্বে চলল আন্দোলন। সকাল-সন্ধ্যা মিটিং। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যেতে থাকে। খবর পৌঁছয় কলকাতায়। তখনও ইংরেজরা ভারত ছাড়েননি। লর্ড মাউন্টব্যাটেন তখনও উপস্থিত। খবর পৌঁছয় তাঁর কানেও। ইতিমধ্যে দুদিন পেরিয়ে গেছে। সমস্ত জায়গাতেই আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছে। পুলিশও পৌঁছে গেছে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন মাউন্টব্যাটেন। ঠিক হল, ম্যাপে রদবদল করা হবে। হিন্দু অধ্যুষিত স্থানগুলি ভারতে চলে আসবে। বাকি কিছু জায়গা থেকে যাবে পূর্ব পাকিস্তানে। 

ঘোষণা কার্যকর হতে চলে এল আরও একটি দিন। ১৮ আগস্ট সুখবর এল নদিয়া, বালুরঘাট, রানাঘাট, শান্তিপুর, মুর্শিদাবাদে। তাঁদের আন্দোলনে ফল মিলেছে তাহলে! এবার গর্বের সঙ্গে ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা তোলা যাবে। শান্তিপুরে কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় তুলেছিলেন জাতীয় পতাকা। বালুরঘাটের প্রতিটি বাড়িতে বেজে উঠেছিল শঙ্খধ্বনি। আজও বনগাঁ, শান্তিপুর, নদিয়ার সীমান্তবর্তী বেশ কিছু অঞ্চল-সহ বাকি অংশে ১৮ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়। শুধু ব্রিটিশ নয়, এ যে পূর্ব পাকিস্তান থেকেও মুক্তি! একটা সময় অনেকের মনে সংকোচ থাকলেও, এখন খোলা মনে রাস্তায় নেমে আসেন তাঁরা। কীসের সংকোচ? কীসের ভয়? এসবের থেকে মুক্তির নামই তো স্বাধীনতা!

আরও পড়ুন
তখনও পরাধীন ভারত; ইংরেজদের হটিয়ে বাংলাতেই জন্ম নিয়েছিল দুটি ‘স্বাধীন’ সরকার

Powered by Froala Editor