আট বছরের এক বালিকা হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। চোখে সে দেখতে পায় না কিছুই। তবে কানে শুনেছিল হায়নার ডাক। সোমালিয়ার (Somalia) পশুপালক পরিবারের মেয়েটি সেদিন ভয় পায়নি। বরং নিজের অজান্তেই সৃষ্টি করে ফেলেছিল তার জীবনের প্রথম কবিতা। সেই হায়নার উদ্দেশে। আর আশ্চর্যের বিষয়, হায়নাটি সেদিন আর কোনো ক্ষতি করেনি মেয়েটির। চোখে সে দেখতে পায়নি কিছুই। জানে না, হায়নাটি চলে গিয়েছিল কিনা। তবু তার বিশ্বাস হয়েছিল, হায়নাটি জঙ্গলের মধ্যে তাকে বন্ধুর মতো এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল অনেকটা রাস্তা। তারপর একসময় জঙ্গল শেষ হয়। ভাইয়ের দেখা পায় মেয়েটি।
তারপর কেটে গিয়েছে ১৮ বছর। সোমালিয়ার সেই ৮ বছরের মেয়ে জামা আবদি এখন প্রতিষ্ঠিত একজন কবি। এখন আর তিনি জঙ্গলের আশেপাশে থাকেন না। তাঁর ঠিকানা এখন রাজধানী মোগাদিশু শহর। এখানে হায়নার উৎপাত নেই। তবু কবিতা লেখা ছাড়তে পারেননি জামা। আসলে মহিলাদের ঘিরে যে সমবসময়ই ঘোরাফেরা করে একদল হায়না। এখন কবিতা লেখেন তাদের উদ্দেশ্য করেই। কবিতাই তাঁর প্রতিবাদের অস্ত্র। সম্প্রতি জামা এবং আরও কয়েকজন মহিলা কবির উদ্যোগে সোমালিয়ার জাতীয় কবিতা প্রতিযোগিতায় আয়োজিত হতে চলেছে মহিলাদের জন্য বিশেষ প্রতিযোগিতা। এই অনুষ্ঠানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে জাতিপুঞ্জও। তবে সোমালিয়ার মধ্যে এই নিয়ে সন্দেহের শেষ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার প্রশ্ন তোলা হয়েছে, কেন মহিলাদের নিয়ে এভাবে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে?
একসময় কবিতার দেশ হিসাবে পরিচিত ছিল সোমালিয়া। অন্তত হাজার বছরের প্রাচীন কবিতা আজও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। আর সেইসব কবিতার কোনোটাই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ছিল না বলেই মনে করেন জামা এবং তাঁর সহযোগী অন্যান্য কবিরা। গত শতাব্দীর শেষদিকে সামরিক শাসন এবং গৃহযুদ্ধের মধ্যেও কবিতাই বারবার হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের অস্ত্র। কখনও কবিতা লেখার জন্য জেলে যেতে হয়েছে কবিকে। কখনও আবার মৃত্যুকেও বরণ করে নিতে হয়েছে। সেইসব সাহসী কবিদেরই উত্তরসূরি জামা আবদি, আশা লুল বা সাদিয়া হুসেনরা। সেইসঙ্গে আবার এতদিনের ইতিহাসকে ভাঙতেও চাইছেন তাঁরা। কারণ সোমালিয়ার ইতিহাসে কবি মানেই শুধু পুরুষদের কথা ভাবা হয়। মহিলারা কি তাহলে কবিতা লিখতেন না এতদিন? সাদিয়া হুসেন বিশ্বাস করেন, তেমনটা সম্ভব নয়। মহিলারাও নিশ্চই কবিতা লিখতেন। তাঁর মা-ঠাকুমারাই তো ঘুম পাড়ানোর সময় কত কবিতা শোনাতেন। অনেক কবিতাই কোনো বইতে পাওয়া যায় না। মহিলাদের মুখে মুখেই জন্ম নিত সেইসব কবিতা।
তবে এবার আর ঘরের মধ্যে বন্দি থাকার সময় নয়। মহিলাদের কবিতাকেও সোচ্চারে সমাজের সামনে হাজির করার সময় এসেছে। এই হাজির করাও তো একধরনের প্রতিবাদ। হয়তো সব কবিতায় পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা থাকবে না। কেউ প্রেমের কবিতা লিখবেন, কেউ লিখবেন প্রকৃতির কবিতা। কিন্তু মহিলারা কবিতা লিখবেন, এবং তা সমাজকে শোনাবেন – এর চেয়ে বড়ো প্রতিবাদ আর কী হতে পারে? তাও খোদ কবিতার দেশের মাটিতেই।
Powered by Froala Editor