স্বাধীন ভারতে ব্রাত্য আজাদ হিন্দ ফৌজ, অথচ তাদের গানই আজও ব্যবহৃত হয় সেনাবাহিনীতে

১৯৪৩-এর ২১ অক্টোবর। সিঙ্গাপুরের ক্যাথে সিনেমাহলে উপস্থিত হয়েছেন খাকি পোশাক পরিহিত আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনারা। সবার লক্ষ্য মঞ্চের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁদের সর্বাধিনায়ক, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। অপেক্ষার প্রহর পেরিয়ে একসময় গর্জে উঠল তাঁর গলা। ঘোষণা হল অস্থায়ী স্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকারের। মঞ্চের পেছনে তখন শোভা পাচ্ছে ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা; মাঝে অশোক চক্র নয়, চরকা। নেতাজি ঘোষণা করলেন, “তোমরা আমায় রক্ত দাও…”

আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক জ্বলন্ত ইতিহাস। দুই বাঙালি, রাসবিহারী বসু এবং সুভাষচন্দ্র বসুর হাত ধরে যে স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয়েছিল, কালে কালে সেটাই ব্রিটিশ সরকারের ত্রাসে পরিণত হয়। সময়টা ১৯৪২। দেশে তখন চলছে ভারত ছাড়ো আন্দোলন। ঠিক কয়েক বছর আগেই ছদ্মবেশী সুভাষ, এলগিন রোডের বাড়ি থেকে পালিয়েছেন। ব্রিটিশ পুলিশ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সেই প্রস্থানপর্ব। ততদিনে শাসকদের রেড লিস্টে উঠে গেছেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যখন শোনা গেল জাপানে আগমন ঘটেছে সুভাষচন্দ্র বসুর, তখন আর চুপ করে থাকলেন না ব্রিটিশরা। আজাদ হিন্দ ফৌজ কোনভাবে যাতে ভারতে ঢুকতে না পারে, তার জন্য চেষ্টা শুরু হল প্রবলভাবে… 

প্রকৃতপক্ষে সেই সময় থেকেই শুরু হয়েছিল আসল লড়াই। আর এই লড়াইয়ের সঙ্গে ছিল গান। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যরা যাতে উদ্দীপ্ত হন, যাতে নিরাশ না হয়ে পড়েন, সেজন্য বেশ কিছু গান তৈরির কথা ভাবেন নেতাজি। আর সেই সূত্রেই সামনে আসেন রাম সিং ঠাকুরি। একটা সময় ব্রিটিশ পুলিশের হয়ে কাজ করতেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিতে চলে গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুর। তখন সিঙ্গাপুর ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গনে ব্রিটিশদের অন্যতম বড়ো মিলিটারি বেস। পরবর্তীকালে জাপানের আক্রমণে সেখান থেকে পিছু হটে ব্রিটিশরা। আর তাঁদের অধীনে থাকা ভারতীয় সেনা ও পুলিশদের বন্দি করে জাপান। পরে তাঁরাই নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজে যুক্ত হন। আর সেই দলেই ছিলেন রাম সিং ঠাকুরি। 

আজাদ হিন্দ ফৌজে থাকাকালীনই নেতাজির নির্দেশে একটি বিশেষ গানের সুর দেন রাম সিং। বংশীধর শুক্লা’র লেখা গানটি ছিল ‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা’। গানটি নিজেই একসময় ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। কেবল আজাদ হিন্দ ফৌজের মার্চ সং হয়েই থাকেনি; সেই সময় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে গানটি। এমনকি ভারত থেকে এর রেকর্ড বের করার সিদ্ধান্ত নেয় একটি গ্রামোফোন কোম্পানি। আর এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখেন ব্রিটিশরা। তড়িঘড়ি রেকর্ড বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তৎকালীন পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনার পি.বার্নেস ঘোষণা করেন, আজাদ হিন্দ ফৌজের এই গানটি ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’। অতএব, এটি বাজানো যাবে না কোনমতেই। 

এতকিছু করেও কি শেষ পর্যন্ত আটকানো গেল গানটি? নিষেধ সত্তেও মুম্বইয়ের একটি গ্রামোফোন কোম্পানি ‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা’-এর রেকর্ড বের করে। গোটা দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গানটি। এবং আজও, নেতাজির মৃত্যুরহস্যের সমাধান না হলেও, তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের এই গানটি স্বাধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশ হয়ে আছে। উল্লেখ্য, এই রাম সিং ঠাকুরির হাত ধরেই তৈরি হয়েছিল আজাদ হিন্দ সরকারের জাতীয় সঙ্গীত ‘শুভ সুখ চ্যায়েন’। ‘জন-গণ-মন’র সুর ধরেই গানটির অবতারণা। 

আজাদ হিন্দ সরকার নিজেই ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। তৈরি হয়েছিল নিজস্ব পতাকা, নোট, জাতীয় সঙ্গীত। রেঙ্গুনে যাওয়ার পর তৈরি হয়েছিল সরকারের নিজস্ব ব্যাঙ্ক, আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক। যে নোট ব্যবহার করা হত, তার একদিকে ছিল নেতাজির মুখ, অন্যদিকে ভারতের মানচিত্র। এমনকি আজাদ হিন্দ সরকারের নিজস্ব রেডিও স্টেশন এবং বাহিনীও ছিল। বাহিনীর ভেতরে তিনটি প্রধান ব্রিগেডের নামকরণ করা হয়েছিল সুভাষ বসু, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু’র নামে। ভাবলে হয়ত অবাকই লাগে আমাদের। স্বাধীনতার পর থেকে ‘নেহরু বনাম সুভাষ’ দ্বৈরথই হল অন্যতম তর্কের বিষয়, সীতারামাইয়াকে নির্বাচনে পরাজিত করার পর গান্ধীজির উক্তি যেখানে অনেকের মনে সন্দেহ জাগায়; সেখানে স্বয়ং সুভাষই তাঁদেরকে সম্মানিত করেছিলেন। এমনকি, আজাদ হিন্দ সরকারের পতাকার মাঝে অশোক চক্র নয়, গান্ধীর চিরপরিচিত চরকা-ই থাকত। 

আরও পড়ুন
জাদু করে মঞ্চে ‘হাজির’ করতেন নিরুদ্দেশ নেতাজিকে, চোখ বেঁধে বাইক চালিয়েছেন কলকাতার রাস্তায়

আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং সেই সরকারের হাত ধরে এইভাবেই তৈরি হয়েছিল ইতিহাস। পরবর্তীকালে কি স্বাধীনতা সংগ্রামীর সম্মান পেয়েছিলেন এই সেনারা? স্বাধীনতার পরে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনারা ভারতের বাহিনীতে জায়গা পেলেন না। সরকারের থেকেও কি সেরকমভাবে সম্মান পেয়েছিলেন? ব্যারাকপুরের নীলগঞ্জে আজাদ হিন্দ ফৌজের কয়েক হাজার সৈন্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ব্রিটিশরা। সে সম্পর্কে একেবারে চুপ হয়েছিল তৎকালীন নেতারা। প্রথমদিকে সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটির উল্লেখ করলেও, পরবর্তীকালে প্রায় চুপ হয়ে যান জওহরলাল নেহরুও। স্বাধীনতার পর এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেভাবে কোনো তদন্ত হলই না। দেশের যে সমস্ত বিত্তশালী মানুষরা টাকা দিয়ে, গয়না দিয়ে ফৌজকে আর্থিক দিক থেকে সাহায্য করেছিলেন, তাঁদেরও মর্যাদা দেওয়া হল না। অথচ সেই আজাদ হিন্দ বাহিনীর কুচকাওয়াজের গান ‘’কদম কদম বঢ়ায়ে যা’ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অঙ্গ হয়ে গেল। কেন এমন ঘটনা ঘটল? বিতর্ক থাকতে পারে। অনেকের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু দিনের শেষে, ভারতের বাইরে দেশের প্রথম অস্থায়ী স্বাধীন সরকারের মর্যাদা তো ক্ষুণ্ণ হতে পারে না! অন্তত, ইতিহাসের কাছে তো নয়ই… 

তথ্যসূত্র-
১) ‘British wanted to ban INA song in last years of its rule’, Shiv Sahay Singh, The Hindu
২) ‘Revisiting events celebrated by Subhas Chandra Bose’s Azad Hind Government’, Sumeru Roy Chaudhury, The Wire

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
অভিনয় করেছেন রবীন্দ্রনাথ, দর্শকাসনে নেতাজিও - থামল কলকাতার রক্সি সিনেমা হলের যাত্রা

More From Author See More