জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে মানব সভ্যতার অন্যতম হাতিয়ার আজ সৌরশক্তি। অপ্রচলিত শক্তির প্রচলনেই লুকিয়ে রয়েছে সভ্যতার ভবিষ্যৎ— দীর্ঘদিন ধরে এমনটা দাবি করে এসেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এই ‘পরিবেশবান্ধব’ সৌরশক্তিই (Solar Energy) যদি দূষণ এবং ইকো-বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়?
হ্যাঁ, একাধিক সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে আসছে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌরপ্যানেল বিশেষজ্ঞ ডঃ রং ডেং-এর কথায়, বিশ্বজুড়ে সৌরপ্যানেল স্থাপন করা হলেও, সেগুলির পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না বিন্দুমাত্র। ফলে, আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই সিলিকন বর্জ্যের পাহাড় জমে যাবে বিশ্বে। যা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয় পৃথিবীর জন্য।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে গোটা বিশ্বজুড়ে মোট এক টেরাওয়াটের বেশি ক্ষমতা উৎপাদন করে সৌরপ্যানেল। প্রতি সৌর প্যানেলের শক্তি-উৎপাদন ক্ষমতা গড় প্রায় ৪০০ ওয়াট। সেই হিসাবে দেখতে গেলে গোটা বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যেই স্থাপিত হয়েছে ১০০ কোটির বেশি সোলার প্যানেল। তবে এই প্যানেলগুলি যে চিরকাল শক্তি উৎপাদন করতে থাকবে, এমনটাও নয়। সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় সোলার প্যানেলের আয়ুষ্কাল মাত্র ২৫ বছর। সেদিক থেকে দেখলে, চলতি দশকের শেষের দিক থেকেই ক্রমশ বর্জ্যের তালিকায় নাম লেখাবে একুশ শতকে স্থাপিত লক্ষ লক্ষ সৌরপ্যানেল। আকস্মিকভাবে বাড়তে থাকবে সিলিকন বর্জ্যের পরিমাণ।
সোলার প্যানেলের মূল উপাদান হল সিলিকন। বর্জ্য হিসাবে সোলার প্যানেলকে ফেলে দেওয়া হলে, সেখান থেকে সিলিকনের কণা প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ দূষণ ঘটাতে পারে বলেই অভিমত রং ডেং-এর। তাঁর কথায়, এই দূষণ মাইক্রোপ্লাস্টিকের থেকে কোনো অংশে কম নয়। সিলিকোসিস-সহ একাধিক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে সিলিকন কণার কারণে। পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ এবং সামগ্রিক বাস্তুতন্ত্রের জন্যও তা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। ফলে, সোলার প্যানেলের পুনর্ব্যবহারই একমাত্র সমাধান এই সমস্যার।
অথচ সার্বিকভাবে সৌরপ্যানেল প্রচলনের পর প্রায় আড়াই দশক পেরিয়ে গেলেও, পুনর্ব্যবহার নিয়ে সেভাবে কোনো বড়ো গবেষণা হয়নি আজও। এমনকি সোলার প্যানেল উৎপাদনকারী সংস্থাগুলিও পুনর্ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ দেখায়নি কোনো। বর্তমানে সৌরপ্যানেল প্রক্রিয়াকরণের যে-কয়েকটি উপায় বিদ্যমান বিজ্ঞানীদের কাছে, তা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। পাশাপাশি সৌরপ্যানেলকে ব্লাস্ট ফার্নেসে ভেঙে ফেলে সেখান থেকে কাচ ও অ্যালুমিনিয়াম অ্যালয় তৈরি করা হয় এই পদ্ধতিতে। তাতে একদিকে যেমন ফার্নেস জ্বালানোর জন্য বিপুল পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়, তেমনই উৎপাদিত কাচ হয় তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের। ফলে, সার্বিকভাবে তা লাভজনক নয় মোটেই।
অন্যদিকে সিলিকন ছাড়া সোলার প্যানেলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল রুপো। সবমিলিয়ে প্রায় ৩ শতাংশের মতো রুপো ব্যবহৃত হয় সৌরপ্যানেলে। সার্বিকভাবে সৌরপ্যানেল পুনর্ব্যবহৃত না-হওয়ার কারণে নিষ্কাশন সম্ভব হয় না এই মূল্যবান ধাতুটিরও। বরং, নতুন সৌরপ্যানেল তৈরির জন্য উৎখনন প্রক্রিয়ার ওপরেই নির্ভর করে থাকে উৎপাদনকারীরা। খনি থেকে রুপো উত্তোলনের এই প্রক্রিয়াও পরিবেশবান্ধব নয় মোটেই।
ফলে সবমিলিয়ে দেখতে গেলে, বাহ্যিকভাবে সৌরশক্তিকে সম্পূর্ণভাবে দূষণমুক্ত শক্তির উৎস হিসাবে ধরে নিলেও, তা পরোক্ষভাবে ক্ষতিসাধন করে চলেছে প্রকৃতির। শুধু অস্ট্রেলিয়ার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাই নয়, এই একই দাবি করেছেন আন্তর্জাতিক পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির নিয়ামক সংস্থার ডেপুটি ডিরেক্টর ডঃ উটে কোলিয়ারও। আগামী এক দশকের মধ্যে পুনর্ব্যবহারের পরিকাঠামো গড়ে না-উঠলে, ২০৫০ সালের মধ্যেই সৌর-বর্জ্যের স্তূপ গড়ে উঠবে পৃথিবীতে, সতর্ক করছেন তিনি। সবমিলিয়ে আগামীটে এক বড়ো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে চলেছে মানব সভ্যতা।
Powered by Froala Editor