ফুটবল জগতের সবচেয়ে ‘রাজনৈতিক’ ব্যক্তিত্ব? বিপ্লবের অপর নাম সক্রেটিস

দেশে চলা হিজাব আন্দোলনের সমর্থনে ইরানের খেলোয়াড়দের জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়া কিংবা ফিফার বিরুদ্ধে জার্মানদের মুখে হাত দিয়ে প্রতিবাদ— কাতার বিশ্বকাপের শুরু থেকে বারে বারে ভিন্নভাবে সরব হয়েছেন ফুটবলাররা। রাউন্ড অফ ১৬-র অস্ট্রেলিয়া-আর্জেন্টিনার ম্যাচেও দেখা গেল সেই প্রতিচ্ছবি। মেসির হাতে সেদিন ছিল ‘এডুকেশন ফর অল’ আর্মব্যান্ড। তা নিয়ে লেখালিখিও হয়েছে বিস্তর। এই প্রথম নয়, বার্সায় খেলার সময় ইউনিসেফের হয়েও একই বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন লিও। তবে ফুটবলের মধ্যে দিয়েও যে প্রতিবাদ গড়ে তোলা যায়, চোখে আঙুল দিয়ে ভুল দেখিয়ে দেওয়া যায় ক্ষমতাশালীদের— সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন এক ব্রাজিলিয়ান তারকা। 

‘ডক্টর সক্রেটিস’ (Doctor Socrates)। হ্যাঁ, এই নামেই তিনি বেশি পরিচিত সেলেকাওদের দেশে (Brazil)। ফুটবল খেলেছেন ঠিকই, উপার্জনও করেছেন বিস্তর, তবে তাঁর কথায় ফুটবল ছিল তাঁর কাছে প্রতিবাদের মঞ্চ। এমনকি ফুটবল আদ্যন্ত একটি রাজনৈতিক খেলা বলেই বিশ্বাস ছিল সেলেকাও-কিংবদন্তির। 

পেলে ও মারাদোনা— এই দুই মাইলফলকের মধ্যবর্তী সময়ের সবচেয়ে বড়ো ফুটবল তারকা হিসাবে অনায়াসেই ধরে নেওয়া যায় সক্রেটিসকে। ধরে নেওয়া যায় সর্বকালের সেরা চিন্তক এবং শিক্ষিত ফুটবলার হিসাবেও। আশির দশকে ইতালির ক্লাবে খেলতে যাওয়ার সময়, স্থানীয় সংবাদমাধ্যম তাঁর সামনে প্রশ্ন রেখেছিল, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ইতালীয় ফুটবলার কে? উত্তরে সক্রেটিস জানিয়েছিলেন, ইতালি তো দূরের কথা, নিজের দেশের ক্লাবের ফুটবলও দেখার সময় নেই তাঁর। তবে ইতালিকে তিনি চেনেন অন্যভাবে। ইতালির শ্রমিক আন্দোলন ও ইতিহাস সম্পর্কে যে-কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম তিনি। সক্রেটিসের পড়াশোনা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় এখান থেকেই। 

১৯৮২ এবং ১৯৮৬— দুটি বিশ্বকাপে হলুদ-সবুজ শিবিরকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বকে উপহার দিয়েছিলেন স্বপ্নের ফুটবল খেলা। তবে বিশ্বকাপের ফেভারিট দল হয়েও দু’বারই অধরা থেকে যায় বিশ্বজয়। ৮৬-তে পেনাল্টি শ্যুটআউটে গোল মিস করেছিলেন স্বয়ং সক্রেটিস। শেষ অবধি সেবার মারাদোনা বিশ্বনায়ক হয়ে উঠলেও, কম চর্চা হয়নি সক্রেটিসকে নিয়েও। 

‘ইয়েস টু লাভ, নো টু টেরর’। সেবার বিশ্বকাপের মঞ্চে এমন বার্তাবহ হেয়ারব্যান্ড পরেই মাঠ কাঁপিয়েছিলেন ঝাঁকড়া চুলের ব্রাজিলিয়ান তারকা। তখন সদ্য লিবিয়াতে বোমাবর্ষণ করেছে আমেরিকা। প্রাণ হারিয়েছে অজস্র মানুষ। আমেরিকার এই ক্রুর আচরণে যেখানে চুপ ছিলেন গোটা বিশ্বের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, সেখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে সামিল হতে পারেন একজন ফুটবলার— এমনটা আশা করেননি কেউ-ই। 

আসলে সাধারণ মেহনতি মানুষের সংগ্রাম ছোটো থেকেই দেখেছিলেন তিনি। তাই চিরকালই শ্রমজীবীদের স্বপক্ষেই লড়াই করেছেন সক্রেটিস। পেলে বা অন্য কোনো ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার নয়, বরং নিজের আইকন করে নিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা, জন লেননের মতো মানুষদের। ১৯৬৪ সাল। ব্রাজিলের ক্ষমতা চলে গিয়েছিল সামরিক রাষ্ট্রনেতার হাতে। তারপরই শুরু হয়েছিল এক অন্ধকার অধ্যায়। দেশজুড়ে নিষিদ্ধ হয়েছিল প্রতিবাদী লেখকদের লেখা বই। ‘মুক্তমনা’ চিন্তাধারা ছড়ানোর ‘অপরাধে’ সে-সব গ্রন্থ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল ব্রাজিলের রাজপথে। সে-সময় এসব বই জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে বাবাকে কাঁদতে দেখেছিলেন কিশোর সক্রেটিস। একদিকে যেমন জানার, পড়ার খিদে বেড়ে গিয়েছিল, তেমনই জেদ চেপে গিয়েছিল কোনো না কোনোভাবে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনবেন তিনি। 

হয়ে ছিল তেমনটাই। আর সেই রাজনৈতিক লড়াই-এর হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ফুটবল। একদিকে যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞানের পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন সক্রেটিস, গাইনোকোলজিস্ট ও অর্থোপেডিক্স হিসাবে কাজ করেছেন বিভিন্ন হাসপাতালে, তেমনই সমান তালে ফুটবল খেলেছেন বোতাফোগো, ফোরেন্তিতা, কোরেন্থিয়ান্সের মতো প্রথম সারির ব্রাজিল ফুটবল ক্লাবে। সে-সময়ই তাঁর হাতে আসে স্বর্ণসুযোগ। দেশের জাতীয় দলে জায়গা পান সক্রেটিস। বছর দুয়েকের মধ্যে বিশ্বকাপে জাতীয় দলের নেতৃত্বও দেন তিনি। 

গোল সংখ্যা, অ্যাসিস্ট কিংবা আন্তর্জাতিক কাপের পরিসংখ্যান দিয়ে সক্রেটিসকে মাপতে গেলে ভুল হবে খানিক। কারণ, সাম্বা জাদুর পাশাপাশি গোটা দেশের সাধারণ মানুষের ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বিশ্বকাপের মঞ্চে সামরিক শাসকের প্রতিবাদ তো বটেই, ১৯৮৪ সালে ব্রাজিলজুড়ে যে ‘ফেয়ার ইলেকশন নাও’ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল, তার অন্যতম পুরোধা ছিলেন সক্রেটিস। দিনের বেলায় চিকিৎসা, তারপর কাজ থেকে ফিরে কোরেন্থিয়ান্সের মঞ্চ থেকে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রচার, রাতে ফুটবল প্র্যাকটিস— সে-সময় এটাই ছিল সক্রেটিসের রুটিন। সক্রেটিসকে কেন্দ্র করে সে-সময় একাধিক প্রতিবাদী সংগঠনও গড়ে উঠেছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। 

ব্রাজিলের এই গণআন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল এক আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। দাবি করা হয়েছিল, এই আন্দোলনে সাধারণের জয় না হলে, সক্রেটিসকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করবে ব্রাজিল প্রশাসন। না, সাধারণ মানুষ মুখ বুজে মেনে নেননি। আগুন জ্বলে ওঠে দেশ জুড়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে উপড়ে ফেলে সামরিক শাসনকে। 

সে-সময়, এমনকি পরবর্তীতেও দেশের প্রেসিডেন্সিয়াল ভোটে সক্রেটিসকে প্রার্থী হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন বহু মানুষ। খোদ লিবিয়ার প্রেসিডেন্টই জানিয়েছিলেন, ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি পদের জন্য যোগ্যতম প্রার্থী সক্রেটিস। তবে সেই পথে পা দেননি তিনি। স্পষ্ট ভাষায় জানান, নেতা এবং রাজনীতিবিদ— এই দুইয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম বিভেদরেখা রয়েছে। আর সেটাই বজায় রাখতে চান তিনি। বজায় রেখেওছিলেন সক্রেটিস। ফুটবল ছাড়ার পর বিনামূল্যে চিকিৎসা করেছেন দরিদ্রদের। গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পরও দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছেন বার বার। আবার ফিফার দূত হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন দুর্নীতির টাকায় বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে। 

রাজনীতির দুনিয়ায় তাঁর এই সরব উপস্থিতি বজায় ছিল ২০১১ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। মৃত্যুর কয়েকের মাস আগে দুঃখের সঙ্গেই সক্রেটিস জানিয়েছিলেন, ফুটবলের ব্যাপক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ব্রাজিলের ফুটবলাররা কেবলমাত্র শিক্ষার অভাবে, তা ব্যবহার করতে পারে না দেশের পরিস্থিতি বদলানোর জন্য। তাঁর সেই দাবিই যেন নতুন করে ফিরে এল মেসির ‘এডুকেশন ফর অল’ আর্মব্যান্ডের দৌলতে… 

Powered by Froala Editor