‘খোঁড়া ন্যাং-ন্যাং-ন্যাং/ কার বাড়িতে গিয়েছিলি কে ভেঙেছে ঠ্যাং...’
ছড়াটা পুরোনো। যুগ যুগ ধরে লোকমুখে ফিরছে। ইস্কুল-কলেজ-চায়ের দোকান-হাসি-হল্লা-টোন টিটকিরি। বাসের কন্ডাক্টর ভাড়া কাটতে গিয়ে সামনে সামান্য বেসামাল ভদ্রমহিলাকে বলে বসছেন, ‘সোজা হয়ে না দাঁড়াতে পারলে প্রতিবন্ধী সিট-এ বসুন।’ আবার স্কুলফেরতা ছানার কানে-কানে ফিসফিসিয়ে মা শেখাচ্ছেন, “কখনো ‘কানা’-কে ‘কানা’, ‘খোঁড়া’-কে ‘খোঁড়া’, ‘পাগল’-কে ‘পাগল’ বলিসনে। ওতে ‘ওরা’ রেগে যায়।” শিশুমনে ‘অস্বাভাবিক’ মানুষকে প্রান্তিকায়িত করার বীজটি সযত্নে বোনা হয় এভাবেই।
ফলে, সমাজের তেরছা নজর গায়ে সেঁটে থাকে তথাকথিত ‘প্রতিবন্ধী’-দের উপর। রাস্তাঘাটে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো সূক্ষ্মভাবেই তাঁরা পড়েন হেনস্থার মুখে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গই ধরা যেতে পারে। দৃষ্টিহীন সায়ন্তন, পেশায় স্কুলশিক্ষক। গতমাসের ২৬ তারিখ, তিনি একটি ‘উবার-বাইক’ বুক করেছিলেন। কিন্তু, উবার-চালক তাঁকে তুলতে এসেই ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখান। সাফ জানিয়ে দেন, তিনি কোনো ‘প্রতিবন্ধী’-কে আরোহী হিসেবে নেবেন না। এই ঘটনার পর ‘উবার’ কর্তৃপক্ষর কাছে অভিযোগও জানিয়েছিলেন সায়ন্তন। তারা নাকি সেই চালকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও নিয়েছে। কিন্তু রোজ এর থেকেও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে বলেই জানাচ্ছেন সায়ন্তন। তাঁর অভিযোগ, উবার-ওলা ছাড়াও র্যাপিডো বাইক সংস্থার চালকরা দৃষ্টিহীন মানুষদের লাগাতার ‘হ্যারাস’ করেন। এমনকি ছিনিয়ে নিয়ে যান টাকা। সুযোগ নেন নিয়মিত। ২০১৬ আর-পি-ডি আইন অনুযায়ী, কোনো ‘প্রতিবন্ধকতা যুক্ত মানুষকে’ শারীরিক অথবা মানসিকভাবে হেনস্থা করাও দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আইন দিয়েই আর কবেই বা কী হয়েছে?
এই ‘সমাজ নিয়ন্ত্রিত’ নিপীড়নের বিপরীতে ‘অপরজন’-দের দিকে বয়ে চলে অবিমিশ্র করুণাও। “আহা রে, লোকটা অন্ধ।” অনেকসময়ই এও একধরণের হেনস্থা হয়ে ওঠে। আত্মসম্মানকে বারংবার খাটো করে, খানিক সান্ত্বনার সুরেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়, ‘তুমি বাপু ঠিক আমাদের মতো না। আলাদা। কমতি। তাই তোমাকে কলা-মুলো-কচুটা আমরা খানিক দয়াপরবশ হয়েই দিয়ে দিচ্ছি আরকি...” এদিকে, দৃষ্টিহীন পরীক্ষার্থীদের জন্য আজও ‘রাইটার’ মেলে না সহজে। অনেকেই স্কুল-কলেজ পাশ করে বসে থাকেন বাড়িতে। চাকরিক্ষেত্রে শুনতে হয়, ‘পারবে তো?’ বেশিরভাগ সময়েই ভাবা হয়, ‘প্রতিবন্ধী কোটা’ আসলে অযোগ্য হয়েও সুযোগ পাওয়ার ছাড়পত্র। অথচ, নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগটুকু পেলে হয়তো উত্তর দেওয়া যেত...
একজন হয়তো তখনই ‘প্রতিবন্ধী’ হয়ে ওঠেন, যখন আমরা তাঁকে সে নজরেই দেখতে থাকি বারবার। মাঝেমাঝে ভাবতে ইচ্ছে করে, ‘স্বাভাবিক’ মানে কী? যা কারও স্বভাব-জাত, তাই তো তার পক্ষে স্বাভাবিক। স্বাভাবিকতা তাই বিচিত্র, পরিবর্তনশীল, স্থায়ী বা স্থাণু কোনো ধারণা নয়। অথচ, সমাজে একটা একরৈখিক বৈশিষ্ট্যকেই দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে ‘স্বাভাবিকতা’ বলে। আর সেই খোপে যারা আঁটেন না, ‘অস্বাভাবিক’ তকমায় তারা হয়ে পড়েন প্রান্তিক। কখনও তাদের ভাবনার কারণে, কখনও রুচিতে, কখনও লিঙ্গপরিচয়ে আবার কখনও বা শারীরিক কারণে... সায়ন্তনের মতো অনেককেই তাই প্রতিমুহূর্তে আক্রান্ত হতে হয়। কখনো সরাসরি হেনস্থা, কখনও বা করুণার ছুরি। শুধুমাত্র উবের-চালকদের দোষ দিয়েই বা লাভ কী? আত্মীয়রাও কি কম যান!
‘স্বাভাবিকতা’-র অসুখে ভুগছে যেন সমাজ। কিংবা অন্ধত্বে। একটা বিশেষ ছাঁদের স্বাভাবিক হতেই হবে সবাইকে। নাহলেই আক্রমণ, কোণঠাসা কিংবা করুণা। মাঝেমাঝে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এই ‘স্বাভাবিকতা’-ও কি একধরণের প্রতিবন্ধকতা নয়?
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়