“হাথরাসের ঘটনাটা যখন শুনি, স্তম্ভিত হয়ে যাই। আরও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম যখন খবর এসেছিল, হাথরাসের নির্যাতিতার মৃত্যুর পর দেহ গোপনে নিয়ে গিয়ে, পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আর সেই কাজটা কারা করল? উত্তরপ্রদেশের পুলিশ! ভারতবর্ষের বুকে এরকম কোনো ঘটনা আগে ঘটেছে কিনা আমি অন্তত মনে করতে পারছি না। অবশ্য হাথরাস ব্যতিক্রম নয়; উত্তরপ্রদেশ ঘুরলে এরকম অনেক উদাহরণ আপনাদের সামনে উঠে আসবে। এখানকার ভয়াবহ পরিস্থিতির কথাও সবাই জানতে পারবে।”
প্রহরকে বলছিলেন রূপরেখা ভার্মা। পরিচয়, লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য। তবে এখানেই থেমে নেই সবটা। তিনি একজন সমাজকর্মী; যখনই অন্যায় দেখেছেন, গর্জে উঠেছেন। সত্তর পেরিয়েছেন আগেই, তা সত্ত্বেও রূপরেখার লড়াই সমাজের বাকি পাঁচজন মেয়ের গলায় আওয়াজ জুগিয়েছে। বেঁচে থাকার সাহস জুগিয়েছে। পুরুষতান্ত্রিকতার পাশবিক আঘাত যে মেয়েদের ওপর নেমে আসে, তাঁদেরকে তিনি ডেকে নেন নিজের কাছে। একসঙ্গে হাতে হাত ধরে শুরু হয় আন্দোলন।
আজ থেকে নয়, সেই ছোট্ট বয়সেই রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন রূপরেখা। আজন্ম বেড়ে ওঠা উত্তরপ্রদেশে। সেখানকার জীবনযাপন, সমাজ, প্রশাসন— সমস্তকিছু নিজের চোখের সামনে দেখেছেন। দেখেছেন একজন মেয়ে হয়ে জন্মানোর ‘সাজা’। দেখেছেন প্রতিদিন কীভাবে সমাজের ‘নিচু জাতের’ মানুষদের কষ্ট সহ্য করতে হয়। তাঁদের বুকের ওপর পা দিয়ে চলে ‘উচ্চ বর্ণের’ বাবুরা। পান থেকে চুনটুকু খসলেই রক্ত ঝরে যায়। কখনও গভীর জঙ্গল, কখনও ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে ভেসে আসে অসহায় তরুণীর চিৎকার। পরেরদিন হয়ত হাপিসই করে দেওয়া হয় তাঁকে। দেখে গেছেন রূপরেখা ভার্মা। যত দেখেছেন, মনের ভেতর চেপে বসেছে এক অদম্য জেদ। যাই হয়ে যাক, এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। তাঁদের আওয়াজ হয়ে উঠতে হবে। সমাজের ধ্বজাধারীদের মুখোশ খুলে ফেলতে হবে।
হাথরাসের ঘটনা তখনও ফিকে হয়ে যায়নি। দিল্লির এইমসে সদ্য মারা গেছেন নির্যাতিতা। তাঁর ‘অপরাধ’, দলিত পরিবারের মেয়ে হয়ে জন্ম হয়েছে পৃথিবীতে। অতএব, পিতৃতন্ত্রের ‘ক্ষুধা’ মেটাও। হাসপাতালে মারা যাওয়ার পরও পরিবারের হাতে দেহ না দিয়ে গোপনে পুড়িয়ে দেয় পুলিশ! এই ঘটনার মধ্যেই আরও বেশ কিছু ধর্ষণের খবর উঠে আসে উত্তরপ্রদেশ থেকে। এখনও শান্ত হয়নি ভারত। রূপরেখা ভার্মার অবশ্য নতুন কিছু মনে হয়নি। ভারত তো বটেই, ছোটোবেলার উত্তরপ্রদেশে এমন ঘটনা প্রায়শই ঘটছে। “আফসোস এটাই, রাজ্য এবং কেন্দ্রের সরকার এই ব্যাপারে কখনও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বরং জাতপাত, ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, হিংসা বেড়েই চলেছে। আর তার বলি হচ্ছে মেয়েরা। বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশের দলিত পরিবার ও তাঁদের মেয়েদের ওপর যা অত্যাচার হয়, সেটা ভাবাও যায় না।”
কথা বলতে বলতে রূপরেখার মনে পড়ে ২০০৫ সালের কথা। লখনউয়ে তেরো বছরের একজন মুসলিম মেয়েকে চলন্ত গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ছয়জন ‘মানুষ’-এর লালসার শিকার হতে হয় ওই ছোট্ট, ফুটফুটে মেয়েটিকে। শুধু তাই নয়, তার শরীরে বেশ কয়েকবার সিগারেটের ছ্যাঁকাও দেওয়া হয়। বিধ্বস্ত অবস্থায় মেয়েটিকে ডালিগঞ্জের রাস্তার ধারে পাওয়া যায়। পরে জানা যায়, ছয়জন অপরাধীর মধ্যে অন্যতম ছিলেন গৌরব শুক্লা, যিনি একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতার ভাগ্নে। “১১ বছর ধরে মামলা লড়ি আমরা। ওই মেয়েটির পরিবারের পাশে কে তখন দাঁড়াবে! এমনকি আমাদের ওপর শারীরিক আক্রমণও করা হয়”, বলছিলেন রূপরেখা। শেষপর্যন্ত জয় পেয়েছিলেন; কিন্তু সেখান থেকে অনেক শিক্ষাও পেয়েছিলেন। আমাদের দেশের সরকারের ভূমিকা নিয়ে বরাবর প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়। এমনকি, সাম্প্রতিক সময় উত্তরপ্রদেশের একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসার পরও সরকার চুপ! হাথরাসের ঘটনায় কার্যত মৌনব্রত নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী। এই দিকেই আঙুল তুলেছেন রূপরেখা।
আরও পড়ুন
অভিযুক্ত ধর্ষকদের বেছে-বেছে খুন করতেন বাংলাদেশের সিরিয়াল কিলার ‘হারকিউলিস’
“সবথেকে বড়ো কথা, দেশের প্রধানের জায়গায় যাকে বসানো হয়েছে, তিনি প্রায় কিছুই বলছেন না। তাহলে কি দলিতরা এভাবেই মার খেতে থাকবে? মেয়েরা এভাবেই নির্যাতিত হবে? আর আমরা, এই ভারতের বাসিন্দা হয়ে কী করছি? আমরা কটা ঘটনায় আওয়াজ তুলছি?” এই কথাগুলো আজকের নয়; সেই ছোটো থেকে দেখে আসা উত্তরপ্রদেশ, ভারতবর্ষের নিরিখে তুলে ধরছিলেন তিনি। আর সেই সূত্র ধরেই তৈরি করেছিলেন নিজের স্বেছাসেবী সংস্থা, ‘সাঁঝি দুনিয়া’। এই সংস্থার মাধ্যমেই নির্যাতিতা মেয়েদের কাছে পৌঁছে যান রূপরেখা। তাঁদের হাত ধরে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যান। সেইসঙ্গে সবাইকে দেখিয়ে দিতে চান, আমাদের সামনে যা উঠে আসছে, পরিস্থিতি তার থেকেও খারাপ। “কারণ কটা ঘটনা থানা অবধি যাচ্ছে, আর কটা ঘটনা শেষপর্যন্ত পুলিশ রিপোর্ট করছে, এর কোনো তথ্য নেই। অনেকক্ষেত্রে এফআইআর নেওয়া হয় না। শুধু উত্তরপ্রদেশ নয়, গোটা ভারতেই এই চিত্র। যা দেখছেন, এসব হিমশৈলের চূড়ামাত্র। অনেকক্ষেত্রে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না; আবার অনেকক্ষেত্রে মামলা এত দীর্ঘকালীন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয় যে নির্যাতিতার পরিবার সেখান থেকে সরে আসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভুগতে তো হয় ওই মেয়েটিকেই!”
‘ঝুঁকিপূর্ণ’ শব্দটি যে কতটা সঠিক, তা উন্নাওয়ের ঘটনা তার অন্যতম বড়ো প্রমাণ। ঘটনাচক্রে, এখানেও পটভূমি সেই উত্তরপ্রদেশ। নির্যাতিতার পরিবারকে কীভাবে শেষ করে দেওয়া হয়, তার নৃশংস উদাহরণ দেখেছে ভারত। সেখানে জড়িয়ে ছিলেন শাসকদলেরই নেতা। আর এখানে আবারও আঙুল তুলছেন রূপরেখা। “বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর আমলে কত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তার কোনো হিসেব করা যাবে না। সংবাদমাধ্যমের সামনে যা এসেছে, তা দেখেই অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু ভেতরের গল্পগুলো শুনলে মনে হবে, আমাদের দেশ আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।” আধুনিক ভারতে দাঁড়িয়ে দলিতদের ওপর অত্যাচারের বর্ণনাই দিচ্ছিলেন তিনি। এই অদ্ভুত সামাজিক কাঠামোর একদম নিচের দিকে থাকার কারণে তাঁদের ওপর আরও বেশি অত্যাচার নেমে আসে। “এখানেই যদি কোনো হিন্দু উচ্চবর্ণের মেয়ে নির্যাতিতা হতেন, আর অপরাধীদের জায়গায় কোনো মুসলিম বা দলিত নাম থাকত, দেশের মিডিয়া, পুলিশ এবং সরকার উঠে পড়ে লাগত। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে একটাই, ধর্ষণের মতো নৃশংস ঘটনাকে কেনই বা জাত-পাত, ধর্মের ভিত্তিতে দেখা হবে?”
আরও পড়ুন
২ সপ্তাহ লড়াইয়ের শেষে মৃত্যু দলিত যুবতীর; কেন ধর্ষণ রুখতে বারবার ব্যর্থ উত্তরপ্রদেশ?
আমাদেরও প্রশ্ন সেটাই। হাথরাসের ঘটনা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে সমাজের নগ্ন, কদর্য রূপটা দেখিয়ে দিল। পুলিশ, নেতা, প্রশাসন— সমস্ত স্তরের মানুষের অন্যায়ই উঠে আসছে এখানে। সংবাদমাধ্যমের একটা বড়ো অংশের বিরুদ্ধেও রাস্তায় নেমেছে মানুষ। ধর্ষণকে একটা ঘৃণ্য, বর্বরোচিত, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবেই দেখা উচিত। সেখানে কেন বারবার অন্যান্য প্রসঙ্গ উঠে আসছে? রূপরেখা ভার্মার গলাতেও শোনা গেল সেই ঝড়ের ইঙ্গিত। “প্রতিটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে আমরা রাস্তায় নেমেছি, পরেও নামব। লড়াই ছাড়া চলবে না। তাতে আমাদের জেল হলে হবে। আমি এবং আমার সংস্থা ‘সাঁঝি দুনিয়া’ নির্যাতিতাদের পাশে দাঁড়াবে।” এইভাবেই বোধহয় জ্বলে ওঠে সূর্য। ভারতের একটা অংশ আজ উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে সেই সত্যের আগুনে। অনেক হয়েছে, আর নয়।
(উদ্ধৃত বক্তব্যের সমস্ত দায় শুধুমাত্র বক্তার)
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ধর্ষণে অভিযুক্তের জামিন, নিজের গায়েই আগুন দিলেন ক্ষুব্ধ তরুণী