আজ থেকে ঠিক ২০ বছর আগের কথা। ওসামা বিন লাদেনের আক্রমণে কেঁপে উঠেছিল নিউ ইয়র্ক শহর। আর ঠিক সেই দিনেই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের (World Trade Center) নর্থ টাওয়ারের কাছ থেকে রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে যান এক ভারতীয় তরুণী। তারপর কম জলঘোলা হয়নি সেই ঘটনা নিয়ে। বেশ কিছুদিন পর তদন্তে নেমেও পুলিশ ০৯/১১ হামলার (09/11 Attack) সঙ্গে তরুণীর অন্তর্ধানের সম্পর্ক অস্বীকার করেন। অবশেষে ৭ বছর পর আদালতের রায়ে সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার হিসাবে স্বীকৃতি পান ডাঃ স্নেহা অ্যানে ফিলিপ। কিন্তু রহস্যের সম্পূর্ণ মীমাংসা আজও হয়নি।
কেরালার কোচি শহরে জন্ম স্নেহা অ্যানের। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন আমেরিকায়। সেখানেই রন লিবারম্যান নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে ঘর বাঁধেন স্নেহা। কিন্তু বিবাহের মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই ঘটে গেল অঘটন। ১০ সেপ্টেম্বর সকালে লিবারম্যানের সঙ্গে শেষ দেখা হয় স্নেহার। তখনও দিব্যি হাসিখুশি তরুণী। সেদিন ভারতে বাবা-মার সঙ্গে ভিডিও চ্যাটও করেছেন স্নেহা। সেইসঙ্গে জানিয়েছেন, সারাদিন কাজের ব্যস্ততার মধ্যে থাকবেন তিনি। এরপর লিবারম্যান নিজের কাজে বেরিয়ে যান। ফিরে আসেন মধ্যরাতে। তখন বাড়িতে দেখতে পাননি স্নেহাকে। অবশ্য তা নিয়ে খুব একটা চিন্তা হয়নি তাঁর। কারণ কাজের সূত্রে মাঝেমাঝেই রাতে বাড়ির বাইরে থাকতে হত স্নেহাকে। এই সময় কেউ ফোন করলেও ফোন রিসিভ করা সম্ভব হত না স্নেহার। লিবারম্যান তাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন বাড়ির কিছু দূরে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নর্থ টাওয়ার মাটিতে মিশে গিয়েছে।
আকস্মিক এতবড়ো ঘটনার ধাক্কা সামলেই লিবারম্যানের খেয়াল হয় এখনও স্নেহার কোনো খবর পাননি তিনি। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি যোগাযোগ। সেদিন বিকালেই নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের কাছে ডায়রি করেন লিবারম্যান। কিন্তু পুলিশ বিভাগের কাছে ততক্ষণে কয়েক হাজার মানুষের নিখোঁজ হওয়ার খবর এসে গিয়েছে। এই অবস্থায় পুলিশের পক্ষে উপযুক্ত তদন্ত সম্ভব হবে না মনে করে লিবারম্যান নিজেই খোঁজ শুরু করে দেন। সেইদিনই জানতে পারেন, আগেরদিন একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কিছু জিনিস কিনে আমেরিকান এক্সপ্রেসের ক্রেডিট কার্ডে টাকা মিটিয়েছেন স্নেহা। তদন্তের একটা সূত্র তিনি নিজেই উদ্ধার করতে পেরেছেন। এরপর কেন গ্যালান্ট নামে এক বেসরকারি গোয়েন্দাকে কাজে লাগান লিবারম্যান। গ্যালান্ট তদন্তে নেমে বেশ কিছু সূত্র উদ্ধার করেন। ১০ তারিখ স্নেহা কোন কোন জায়গায় ঘুরেছেন, তার একটা ছক মোটামুটি পাওয়া যায়। বেশ কিছু কেনাকাটা করেছিলেন স্নেহা। ম্যানহাটনের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে একটি সিসিটিভি ফুটেজও পাওয়া যায়। এরপরই গ্যালান্ট স্নেহা-লিবারম্যানের ফ্ল্যাটের সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করেন। সন্দেহ আগেই হয়েছিল। সেদিন ভোররাতে লিবারম্যানের ফোনে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল। লিবারম্যান স্পষ্ট কিছু মনে করতে পারেননি, তবে জানিয়েছিলেন তিনি সম্ভবত ঘুমের মধ্যে কোনো কারণে দরজা খুলেছিলেন। ফ্ল্যাটের সিসিটিভি ফুটেজেও লিফটের কাছে দেখা যায় এক তরুণীকে। কুয়াশায় স্পষ্ট চেহারা বোঝা না গেলেও স্নেহার চেহারার সঙ্গে তার যথেষ্ট সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। আর লিবারম্যানের ফোনের সময়ের সঙ্গেও মিলে যায় সেই ফুটেজের সময়। যদিও এই প্রমাণকে নিশ্চিত বলে মানতে নারাজ ছিলেন গ্যালান্ট নিজেও। সবচেয়ে বড়ো সন্দেহের কারণ, স্নেহা নিজের নম্বর থেকে ফোন না করে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করবে কেন?
গ্যালান্ট অবশ্য আশা করেছিলেন স্নেহা তখনও বেঁচে আছেন। আর তা যদি সত্যি হয়, তাহলে সন্ধান পাওয়ার একমাত্র সূত্র আমেরিকান এক্সপ্রেসের ক্রেডিট কার্ড। কিন্তু এরপর আর কোনোদিন সেই ক্রেডিট কার্ড থেকে কোনো লেনদেন করা হয়নি। অবশেষে গ্যালান্ট মন্তব্য করেন, ট্রেড সেন্টার হামলার সময় হয়তো পেশার তাগিদেই আহতদের চিকিৎসার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন স্নেহা। আর সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে নিউ ইয়র্ক পুলিশ এই তত্ত্ব মানতে রাজি হয়নি। ২০০৩ সালে তাঁরা তদন্ত শুরু করেন। তবে তদন্তের নামে যে সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে নাড়াঘাঁটা শুরু হয়, তা মিথ্যা এবং অপমানজনক বলেই মনে করেছিলেন স্নেহার পরিবারের সদস্যরা। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় এর আগে একাধিক সংস্থা থেকে স্নেহা বহিষ্কৃত হয়েছে মাদকাসক্তির কারণে। তবে লিবারম্যানের মতে, মাদকাসক্তির জন্য নয়, বরং সেইসন সংস্থার জাতিবিদ্বেষী এবং লিঙ্গবিদ্বেষী ব্যবস্থার প্রতিবাদ করাতেই কাজ হারাতে হয় স্নেহাকে। এর মধ্যে স্নেহার ভাইয়ের স্ত্রীকে জড়িয়ে তাঁকে সমকামী আখ্যা দেওয়ার চেষ্টাও করে পুলিশ। যে তথ্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেয় স্নেহার পরিবার। পাশাপাশি এই প্রশ্নও ওঠে, তাঁর যৌনপরিচয়ের সঙ্গে নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনার কী সম্পর্ক?
আরও পড়ুন
নিরাপদ নয় শরণার্থী শিবিরও, ইজরায়েলি হামলায় মৃত্যু এক পরিবারের ৮ শিশুর
নিউ ইয়র্ক পুলিশ শেষ পর্যন্ত জানায় স্নেহা অ্যানে নিজের ইচ্ছায় পালিয়ে গিয়েছেন। এর সঙ্গে ০৯/১১ হামলার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন থেকে যায়, তিনি যদি সত্যিই পালিয়ে যাবেন তাহলে পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে শুরু করে একাধিক ক্রেডিট কার্ড কেন ফেলে গিয়েছেন? আর সেসব ছাড়া কতদূরই বা পালানো সম্ভব একজন মানুষের পক্ষে? এই সমস্ত বিষয়কে সামনে রেখে বারবার আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে স্নেহার পরিবার। অবশেষে ২০০৮ সালে স্নেহাকে সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার বলে মেনে নেয় সরোগেট আদালত। ০৯/১১ হামলার মৃতের তালিকায় শেষ সংযোজিত নামটাই স্নেহার। যদিও ঘটনাস্থলে তাঁর কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি কোনো গয়নার টুকরোও না। তবে সেদিনের হামলায় এমন অনেকেরই কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁদের সবাইকেই হামলায় নিহত বলেই ধরে নিয়েছে প্রশাসন। শুধু আদালতের রায়ের পরেও আজও কাগজে-কলমে স্নেহা অ্যানেকে সেদিনের ঘটনায় মৃত বলে মেনে নিতে রাজি নয় নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগ। তা কি শুধুই স্নেহা একজন ভারতীয় বলেই?
আরও পড়ুন
বিস্ফোরক, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা নাইজেরিয়ার কারাগারে; পলাতক ১৮০০ বন্দি
তথ্যসূত্রঃ
১. The Disappearance of Sneha Philip, Christine, The True Crime Files
২. The enduring 9/11 mystery of missing Dr. Philip, DailyMail.Co
Powered by Froala Editor