দাবা হোক বা জীবন, চৌষট্টি খোপের যুদ্ধে শিখর ছোঁয়াই লক্ষ্য জাতীয় চ্যাম্পিয়ন স্নেহা-র

“আমি সামান্য প্রাইভেট টিউশনি করি। সেটাই একমাত্র আয়ের রাস্তা। তাও মেয়ের স্বপ্ন যাতে পূরণ হয় সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার মেয়েও খুব জেদি। ওর লক্ষ্য বাংলার গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া। আরও আরও দূরে এগিয়ে যাওয়া। ওর মা-ও অনেক কষ্ট করছে, আমিও করছি। কিন্তু আমরা হার মানিনি পরিস্থিতির কাছে। আর্থিক অবস্থা খারাপ হলেও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি মেয়েকে। আরও এগিয়ে নিয়ে যাব।”

প্রহরকে বলছিলেন ভগীরথ হালদার। না, আজকের গল্পে তিনি মুখ্য চরিত্র নন। বরং মঞ্চে উঠে আসবে তাঁর মেয়ে— স্নেহা হালদার। বাংলার দাবা জগতের খবরাখবর যারা রাখেন, তাঁরা এই নামটির সঙ্গে নিশ্চয়ই পরিচিত হবেন। বাংলার নতুন প্রজন্মের দাবাড়ুদের মধ্যে অন্যতম প্রতিভা মনে করা হচ্ছে তাকে। বয়স মাত্র ১১ বছর, এরই মধ্যে দেশ বিদেশের একাধিক খেতাব অর্জন করেছে স্নেহা। তবে এই লড়াই শুধু খেলাতেই থেমে নেই। জীবনের চৌষট্টি খোপেও চলছে লড়াই। একের পর এক দানে কখনও উঠে আসছে আশা, কখনও লেগে থাকছে এক টুকরো অন্ধকার।  

কলকাতার তারাতলায় ছোট্ট এক চিলতে ঘর, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। সংসারে আয় বলতে বাবা ভগীরথ হালদারের টিউশনি। যা আসে, আজকালকার বাজারে তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা অদ্ভুত চোরাস্রোত বয়ে যাচ্ছে এই পরিবারে। দাবার নেশা যেন জড়িয়ে আছে ভগীরথবাবুর সঙ্গে। একটা সময় নিজেও খেলতেন; নানা বইপত্র পড়ে খেলার নিয়ম রপ্ত করেছেন। তারপর থেকেই নেশায় ঢুকে গেল রাজা, মন্ত্রী, গজ, নৌকার দুনিয়া। স্নেহার জন্মের পর তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ওকেই দাবা শেখাবেন। কিন্তু ঘরের অবস্থা তো ভালো না। কোথাও ভর্তি করানোরও সামর্থ্য নেই! অগত্যা নিজেই তুলে নিলেন কোচের ভূমিকা। বাবা ভগীরথের হাত ধরেই দাবার গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়া স্নেহার। 

আরও পড়ুন
করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নার্স হোচিমিন, বাংলাদেশের ট্রান্সজেন্ডার আন্দোলনের অন্যতম মুখও তিনিই

আরও পড়ুন
‘ছেলে থাকলে উপার্জন আসত সংসারে’, অভাবী মায়ের ভুল ভাঙছেন ২১ বছরের বাঙালিনী

মেয়ের সহজাত প্রতিভা, লড়ে যাওয়ার মানসিকতা, পরিশ্রম ও ঠান্ডা মস্তিস্ক নজর এড়ায়নি তাঁর। বাবা আর মেয়ের এমন যুগলবন্দী উঠে আসে জাতীয় মঞ্চে। জাতীয় মিটের অনূর্ধ্ব ৭ বিভাগে যখন স্নেহা রুপোর পদক পেল, তখন সবাই চমকে যান! কোনো ভালো জায়গায় না শিখে, স্রেফ ঘরোয়া ট্রেনিং নিয়ে, এমন পারিবারিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়ে এই মেয়ে গোটা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় হল! এখান থেকেই শুরু হল উত্থান। ইতিমধ্যেই স্নেহার ওপর নজর পড়ে বাংলার প্রখ্যাত দাবাড়ু দিব্যেন্দু বড়ুয়ার। বিনামূল্যে তাঁর কাছ থেকে ট্রেনিং নেয় স্নেহা। তবে গল্প এখানেই শেষ নয়… 

আরও পড়ুন
জাতিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই, 'অস্ত্র' মেয়েদের ফুটবল ক্লাবও - দিনবদলের স্বপ্ন বুনছেন প্রতিমা

আরও পড়ুন
স্বনির্ভরতাই যথেষ্ট নয়, উদ্যোগপতি হয়ে উঠুক গ্রামের মেয়েরা - অন্যরকম লড়াই শিবানীর

“আমাদের ঘরে ট্রফি রাখারও জায়গা নেই। ছোট্ট একটা ঘরে কোনোরকমে কেটে যায় আমাদের। বাধ্য হয়ে অনেক ট্রফি বস্তায় বেঁধে গ্রামে রেখে দিয়ে এসেছি। কিন্ত আমার অনেক জেদ। আমার মেয়েও তেমন হয়েছে। কিন্তু শুধু জেদ থাকলেই তো হবে না! বাংলায় খেলে গেলে তো স্নেহার কোনো উন্নতি হবে না খেলায়। ওকে বাইরে নিয়ে যেতে হয়। কখনও রাজ্য, কখনও বিদেশ— তার একটা ধাক্কা তো আছেই। কিন্তু ওর খেলার জন্য সেটাও করতে হবে।” ভগীরথবাবুর কথা শুনে মনে হয়, উনিও একটা দাবার লড়াইয়ে নেমেছেন। প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জীবন, দারিদ্র। একের পর এক চালে চেকমেট হয়ে যাওয়ার শঙ্কা; কিন্তু হার মানতে নারাজ। দাঁত কামড়ে পড়ে আছেন মাঠে। স্নেহাও হতাশ করেনি কখনও। তার রেকর্ড শুনলে অবাক হতে হয়। দুবার রাজ্য চ্যাম্পিয়ন, ন্যাশনাল গোল্ড, ন্যাশনাল সিলভার, কমনওয়েলথ গোল্ড, ব্রোঞ্জ— এর বাইরে আরও প্রচুর পুরস্কার পেয়েছে সে। আর সবই অনূর্ধ্ব ১০ পর্যায়! চিন, ব্রাজিল, নেপাল, শ্রীলঙ্কা— একের পর এক জায়গায় ভারতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছে স্নেহা। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় গোটা পৃথিবীতে ১২ তম স্থান দখল করেছিল। 

এই বয়সেই এমন গ্রাফ যার, তার স্পনসর পেতে সমস্যা। বলতে গিয়ে গলাটাও যেন থমকে আসে ভগীরথ হালদারের। দুঃখের কথা মনে করতে চান না। পেছনের দিকে তাকাতে চান না। তাও মনে আসে অনেক কথা। ক্ষোভ উগড়ে পড়ে বাংলার দাবার জগত নিয়ে। যেখানে স্নেহার মতো প্রতিভার বিচার হয় না। আগে এগোতে চাইলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় অর্থ। তাও ২০১৭ সাল থেকে স্নেহা হালদার এবং তার পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে একটি বেসরকারি ফাউন্ডেশন। চেন্নাই থেকেও এসেছে অর্থসাহায্য। পাশে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গ শিশু সুরক্ষা দফতর। তাই নিয়েই এগিয়ে চলেছে স্নেহা। হাজার হাজার পুরুষদের ভেতর একা মেয়ে হয়ে ও দাঁড়াতে চায়। বাংলা এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চায়। হতে চায় বাংলার অন্যতম গ্র্যান্ডমাস্টার। এর আগে দাবার জগতে মেয়েদের নাম সেভাবে শোনা যেত না। স্নেহা কি পারবে সেই বেড়া টপকাতে? দারিদ্র আর জীবনের এমন খোপে সেও পাকা খেলোয়াড়ের মতো চাল দিতে চায়। আমরাই বা কতজন জানি এমন কাহিনি! বাংলার বুকে এমন স্নেহারাই আরও উঠে আসুক; বদলে যাক সমস্ত পরিবেশ। অর্থ যেন প্রতিভার কাছে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়, সেটাও দেখার দায়িত্ব আমাদেরই। স্নেহা হালদার এবং তার পরিবার সেই গণ্ডি পেরোনোরই আরেক নাম।

Powered by Froala Editor