“যখন বিহারে কাজ করতে আসি, তখন এখানকার পরিস্থিতি নিয়ে কিছু কিছু ঘটনা কানে আসত। কিন্তু আসল জায়গায় এসে দেখি, যা ভেবেছিলাম তার থেকেও ভয়ংকর! আজ হাথরাসের ঘটনা নিয়ে গোটা দেশ উত্তাল। একটু খোঁজ নিলে এরকম আরও কত ঘটনা উঠে আসবে আমাদের সামনে। দলিত মহিলাদের ওপর অত্যাচার করা যেন রুটিনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকেই আমাদের লড়াইটা শুরু হয়। আজও এই মানুষগুলোর জমি শক্ত করার জন্য কাজ করছি। যতদিন থাকব করে যাব…”
প্রহরকে বলছিলেন স্মিতা থমাস পারমার। জন্ম গুজরাটের এক খ্রিস্টান পরিবারে। সেখান থেকে বিহারের বৈশালী জেলার দরিদ্র মানুষগুলোর সহায় হয়ে উঠেছেন। নিজের পরিবার থেকে দূরে, আরও বড়ো পরিবারের কাছে। যেখানে প্রতিনিয়ত চলে জীবনের সংগ্রাম, বেঁচে থাকার লড়াই। সমাজের বাকি অংশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে হয়। পান থেকে চুনটি খসলেই শেষ তুমি! স্মিতা দেখেছেন এমন মানুষদের কষ্ট। সেই স্রোতেই নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছেন।
স্মিতার সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে গেলে চোখে পড়বে একটি লাইন। ‘যো ঠান লু ওহ করতি হু’— যেটা একবার মনে করেছি সেটা করেই ছাড়ি। এমনই জোর লুকিয়ে আছে তাঁর ভেতরে। নম্র, শান্ত হাসিটার আড়ালের লড়াকু চেহারাটা বেরিয়ে পড়তে বিশেষ সময় লাগে না। ছোটোবেলাতে দেখেছিলেন, বাড়ির সবাই চার্চে যাচ্ছেন। প্রভু যিশুর কাছে প্রার্থনা করছেন। স্মিতা নিজেও ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে নিজের দায়িত্ব এতটুকুও ভোলেননি। মানুষ! মানুষের পাশে দাঁড়াবেন তিনি। প্রথমে ভেবেছিলেন ব্যবসা করবেন, নিজের একটা সংগঠন শুরু করবেন। তারপর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখেন আশেপাশের মানুষদের। কী অসহায়ভাবে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা! আচ্ছা, এঁদের পাশে দাঁড়ানো যায় না? এঁদের সঙ্গে কোনো কাজ করা যায় না। পড়াশোনা করার পর যখন সেই কাজের সুযোগ এল, তিনি বেছে নিলেন বিহারকে। কিন্তু বিহারই কেন?
“ছোটোবেলায় শুনেছিলাম, বিহারে জাতিভেদ প্রথার প্রচণ্ড খারাপ প্রভাব রয়েছে। একটা সময় দুই বছর বিহারে ছিলাম একটা কাজের সূত্রে। তখন অনেকটা কাছ থেকে ওখানকার মানুষদের দেখি। ওঁদের জীবনযাত্রা দেখে আমি একেবারে ভেঙে পড়ি। শিক্ষা পৌঁছয়নি সব জায়গায়, উন্নয়ন নেই; কিন্তু সব জায়গায় আঁকড়ে ধরে আছে জাতপাত। সমাজের উঁচু তলার মানুষরা সুযোগ পেলেই দলিতদের অত্যাচার করে। এমনকি এও শুনেছিলাম, মহাদলিত সম্প্রদায়, যারা সমাজের সবচেয়ে নিচু স্তরে বেঁচে থাকে, তাঁরা নাকি ইঁদুর মেরে খায়! বাজার, চাষের জমির ধারে যে পচা ফেলে দেওয়া সবজি-ফল-খাবার থাকে, সেগুলো খায়! প্রথমে মনে হয়েছিল, সব রটনা। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেখি, রটনা নয়! এইসব সত্যি!”
আধুনিক পৃথিবী, এমন দৃশ্য কি ভাবতে পেরেছ স্বপ্নেও? বেঁচে থাকার জন্য ছোটো ছোটো ইঁদুর মেরে খাচ্ছে মানুষরা! কথাটা বলতে গিয়ে যেন ছবিটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। শিউরে উঠলেন স্মিতা পারমার। “আমি স্বপ্নেও ভাবিনি এমন দৃশ্য দেখতে হবে। এরকম ভাবেও বেঁচে আছে মানুষ! তখনই ঠিক করি, এই দলিত মানুষদের নিয়ে কিছু করা উচিত। তাঁদের শিরদাঁড়া শক্ত হওয়া দরকার।” ব্যস, তখন থেকেই শুরু স্মিতার পথ চলা। বৈশালীতে ‘মেডিক্যাল মিশন সিস্টারস’ সংগঠনের হয়ে কাজে নামা। আজও থামেনি পথ চলা। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত কাজ চলছে। গরিব মানুষদের দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করিয়েও টাকা দেওয়া হচ্ছে যৎসামান্য। যেন না দিলেই নয়! এদিকে ওঁরাও প্রতিবাদ করতে পারছেন না। যখনই কেউ রুখে দাঁড়িয়েছে, তাঁর গলা টিপে ধরেছে সমাজের ‘উচ্চবর্ণের’ মানুষরা।
আরও পড়ুন
‘হাথরাসে কোনো ধর্ষণই হয়নি’, খবর ঘোরাতে পিআর এজেন্সিকে বরাত ইউপি সরকারের?
কাজ করতে গিয়ে একটু একটু করে যেন পর্দা উঠতে থাকে। স্মিতা দেখেন, দলিত মেয়েদের ওপর কীভাবে নেমে আসে অত্যাচার! আজ গোটা দেশ হাথরাসের ঘটনা নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। “আমি তো সবাইকে বলি, তোমরা এসো, এসে দেখে যাও পরিস্থিতি। এরকম কত হাথরাস তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন!”, বলছিলেন স্মিতা। বিহারে কাজ করতে গিয়ে দেখেন, উঁচু জাতের মানুষ বলে যারা নিজেদের জাহির করে, তারাই রাতের অন্ধকারে সোজা গিয়ে ঢুকে পড়ে দলিতদের বাড়ি। পরিবারের বাকি লোকের সামনেই ঘরের মেয়েদের ওপর চলে নির্যাতন। প্রতিদিন ধর্ষিতা হন এখানকার মেয়েরা। একে দলিত, তার ওপর মেয়ে— অতএব, চালাও গুলি! কী বলবে পরিবার? সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে আগুন ধরে যাবে। তাঁদেরকে আর কেউ কোনোদিনও খুঁজে পাবে না…
“গত সপ্তাহের ঘটনা। একটি বাড়িতে যাই আমি। গিয়ে দেখি, উঠোনের একদিকে একটি মেয়ে, আর অন্যদিকে তাঁর সদ্যোজাত কন্যাসন্তান। মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কী হয়েছে? কন্যাসন্তান জন্মানোর অপরাধ! পরিবারের সবাই, এমনকি মেয়েটির স্বামীও তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে। বাড়িতে ওই অবস্থায় একা বসে আছে ও। শিশু ও মা— কারোর অবস্থাই ভালো ছিল না। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাই আমি। ভাগ্যক্রমে, বেঁচে যায় ওরা।” কিন্তু এরকমভাবে কতদিন? তাই প্রতিদিন, সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যান স্মিতা পারমার। সঙ্গে থাকে তাঁর দল। সবাই দলিত— ছেলে, মেয়ে উভয়ই আছে সেখানে। হ্যাঁ, দলিত ছেলেরাও যাতে রুখে দাঁড়ায়, নিজেদের পরিবার ও প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়াতে পারে সেই জোরই তৈরি করছেন স্মিতা।
আরও পড়ুন
ধর্ষণ শুধুই যৌনাঙ্গ-নির্ভর নয়; যৌনতার ভাষা শিখতে হবে প্রথমে : মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়
আজ বৈশালীতে সবাই তাঁকে মানে। সবাই সম্মান করে। যখনই কিছু ঘটে, তাঁর কাছে খবর দিতে আসে লোকজন। কিন্তু এরকম পরিস্থিতি ছিল না। “দলিতরা নিজের পায়ে দাঁড়াক, এটা সমাজের ওপরতলার মানুষরা চায় না। তাই প্রতি পদে বাধা আসত, এখনও আসে। যখন আসি, ধর্ষণ প্রায় প্রতিদিনের ব্যাপার ছিল। আমি সেই নির্যাতিতাদের মনে সাহস দিই। অনেকসময় ধর্ষণ হওয়ার আগেই আমরা পৌঁছে যাই। ওঁরা যাতে পায়ের তলার শক্ত জমিটা ফিরে পায়, তার চেষ্টা করি। কয়েক বছর আগে বিহারে এক সরকারি হোস্টেলের ভেতর একজন দলিত তরুণীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। তারপর দেহ নর্দমায় ফেলে দেওয়া হয়! যেন কিছুই হয়নি! তখন আমরা রাস্তায় নামি, মিছিল করি। বহু জায়গা থেকে মানুষ আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন। এই সময় হুমকিও শুনতে হয়েছে। আমার ওপর আক্রমণও হয়েছে। কিন্তু আমি হার মানিনি। কারণ, আমি যদি হার মেনে যাই, এঁদেরকে সাহস দেওয়ার আর কেউ থাকবে না”, বলছিলেন স্মিতা পারমার…
আরও পড়ুন
থানা অব্দি পৌঁছয় না অনেক ধর্ষণের ঘটনাই, ক্ষোভে ফুঁসছেন উত্তরপ্রদেশের সমাজকর্মী রূপরেখা ভার্মা
মাদার টেরেসা তাঁর আদর্শ। কিন্তু মাদারকেও তো একটা সময় কম অপমান সহ্য করতে হয়নি। যখনই হরিজন, দলিতদের পাশে এগিয়ে এসেছে খ্রিস্টানরা, অপপ্রচার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ধর্মান্তরিত করার জন্যই এসব সেবা করছে ওঁরা। তাই ‘ওঁদের ফাঁদে পড়ো না’। স্মিতাকে এসব সহ্য করতে হয়নি? ফ্ল্যাশব্যাকে যেন মনে পড়ল অনেকগুলো ঘটনা। চমকে উঠলেন স্মিতা। “হ্যাঁ! কত কথা শুনতে হয়েছে বিশ্বাস করবেন না। গ্রামে গ্রামে গিয়ে আমাদের নামে, আমার নামে ভুল প্রচার চালানো হয়েছে। কিন্তু এরকম কাজ করার কথা কখনও মাথায় আসেনি। আমার কাছে আসল হল মানুষ। ওই দলিত মানুষরা যাতে উঠে দাঁড়ায় তার জন্য প্রাণপণ কাজ করে যাই। খারাপ লোক তো থাকবেই। আমি সব ধরণের উৎসব অনুষ্ঠান আয়োজন করি, যাতে সবাই এসে একসঙ্গে জড়ো হয়। এবং সেই ছবিটাই আমার সামনে সবসময় ফুটে ওঠে। ওঁরা বলে যাক, আমি আমার কাজ করব। কাজ করছি বলেই না এত মানুষ আমার সঙ্গে আছে!” সেই নির্ভীক গলা!
স্মিতা এমনটাই। তিনি চান, দলিতরা নিজেরাই যেন নিজেদের আওয়াজ হয়ে ওঠে। “আমি আর কতদিন থাকব। কিন্তু এই মানুষগুলোকে তো বাঁচতে হবে! প্রজন্মের পর প্রজন্ম এমনটা তো চলতে পারে না! মরা ইঁদুর খেয়ে বেঁচে থাকবে না! একদিন ওঁদের আর কাউকে প্রয়োজন হবে না। ওঁরাই হবে আন্দোলনের মুখ। ওঁরাই ভেঙে দেবে জাতপাতের বেড়া। সেটাই তো আসল কাজ, নয় কি!” হেসে ওঠেন স্মিতা। চোখে অনন্ত স্বপ্ন। বৈশালীর দলিতদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। মেয়েদের ভরসা হয়ে উঠেছেন। তবে কাজ যে এখনও অনেক বাকি। এই দেশ থেকে জাতপাত, ধর্ম নিয়ে হিংসা উঠে যাবে একদিন। ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে’। যাবেই…
Powered by Froala Editor