মাত্র এক মাস আগের কথা। ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ২২ সেপ্টেম্বর। পশ্চিম মালির কায়েস অঞ্চলে তখন চলছে উৎসব উদযাপন। আগুন জ্বালিয়ে বৃত্তাকারে নাচছিলেন কিছু তরুণ-তরুণী। দিনটা যে সে-দেশের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু হঠাৎই যেন অন্ধকার নেমে এল এই উদযাপনে। ধারালো ছোরা এবং লাঠি নিয়ে তাঁদের আক্রমণ করলেন একদল মানুষ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছুরির আঘাতে প্রাণ হারালেন একজন। আহত হলেন অন্ততপক্ষে ১২ জন মানুষ।
কী ভাবছেন, কোনো সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ? নাকি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অন্তর্দ্বন্দ্ব? আদতে কোনোটাই নয়। সেপ্টেম্বরে মালির বাফৌলাবে শহরে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় ‘দায়’ ছিল আহত ও নিহত মানুষগুলিরই। আর তারই ‘যোগ্য শাস্তি’ পেয়েছে তাঁরা। কেননা, তাঁদের আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাধীনতা উদযাপনের অধিকার নেই। কেননা, তাঁরা ক্রীতদাস পরিবারের উত্তরসূরি। সম্ভ্রান্তদের শুশ্রূষা করাই তাঁদের একমাত্র কাজ। শুনে অবাক লাগছে নিশ্চয়ই? তবে এমনটাই সত্যি। এক শতাব্দী আগে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাওয়া দাস প্রথা এখনও ‘স্বমহিমায়’ চালু আছে আফ্রিকার দেশ মালিতে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে পৃথিবীতে দাসপ্রথা প্রচলিত রয়েছে একেবারে প্রস্তর যুগ থেকেই। যদিও তা ভয়াবহ চেহারা নেয় ষোড়শ শতক থেকে। মালিতে দাসত্বের সূত্রপাত সেইসময়েই। প্রথমে মরক্কো তারপর অন্যান্য ইউরোপিয় ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাবে ক্রমশ দাসত্বের অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল মালি।
তবে শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক শক্তিই নয়, মালির সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও উঠে যায় সুস্পষ্ট বিভেদরেখা। গোটা সমাজ কাজ এবং অর্থের নিরিখে ভাগ হয়ে যায় মূলত চারটি শ্রেণিতে— নোবেল (সম্ভ্রান্ত), চিফ (শাসক/ ক্ষত্রিয়), আর্টিসান (শিল্পী-কারিগর) এবং দাস। ১৯০৫ সালে ফরাসি সরকার আইন করে দাসত্ব নিষিদ্ধ করলেও, মালির সাধারণ মানুষের মানসিকতা থেকে মুছে যায়নি মধ্যযুগীয় এই প্রথা। বরং, ১৯৬০ সালে স্বাধীনতার পর আরও প্রকট হয়ে ওঠে এই বিভাজন। অবশ্য এখনও খাতায় কলমে সেখানে নিষিদ্ধ দাসত্ব।
হিসেব বলছে ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে শুধুমাত্র কায়েস প্রদেশেই অর্থের বিনিময়ে বলপূর্বক স্থানান্তরিত করা হয়েছে ৩ হাজারের বেশি মানুষকে। তাঁরা বংশানুক্রমে দাসত্বের শিকার। গোটা দেশে সংখ্যাটা লাখের কাছাকাছি। এই বিশেষ শ্রেণির মানুষের কাছে এখনও স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার নেই, নেই নিজস্ব আর্থিক সম্বল, বাসস্থানও। মালিকদের বাড়িতে থেকে তাঁদের সেবা-শুশ্রূষা করা এবং সমস্ত কায়িক শ্রমের কাজ করার ক্ষেত্রেই একমাত্র দায়বদ্ধ তাঁরা। আর তা অমান্য করলে বা প্রতিবাদ জানালে? পরিণতি ভয়ঙ্কর। মানসিক নির্যাতন, প্রহার, অনাহারের পরেও রয়েছে এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে বিক্রি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।
কিন্তু একেবারেই কি প্রতিবাদ হচ্ছে না মালিতে? না, তেমনটা নয়। বর্তমানে মালিতে গড়ে উঠেছে একাধিক দাসত্ব-বিরোধী এনজিও। তবে প্রকাশ্যে মাঠে নেমে সেই প্রতিবাদ চলছে না। বরং, হাতিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া। ডিজিটাল মাধ্যমে মধ্যযুগীয় এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন প্রায় দু’ লক্ষাধিক মানুষ। তাতে সরাসরি দেশের অভ্যন্তরীণ সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় প্রভাব না পড়লেও, আন্তর্জাতিক সাড়া মিলছে তো বটেই। সেপ্টেম্বরে ঘটে যাওয়া ঘটনার দৃশ্যও প্রকাশ্যে এসেছিল সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতেই। রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং ইউরোপিয় শক্তিগুলির চাপে শেষ পর্যন্ত ঘটনার ২ সপ্তাহ পরে মুখ খুলেছিল মালি প্রশাসন। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন দেশের একাধিক মন্ত্রীস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। জানিয়েছিলেন গ্রেপ্তার করা হয়েছে নৃশংসতায় জড়িত থাকা ব্যক্তিদের। যদিও প্রতিবাদকারীদের দাবি, এই ধরনের কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। এমনকি একাধিক আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থার গবেষণা-পর্যবেক্ষণের পরেও মালির শাসকদের দাবি, দাসত্বের অস্তিত্ব নেই সে-দেশে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, স্বয়ং রাষ্ট্রই যদি অস্বীকার করে, তবে শতাব্দীপ্রাচীন এই প্রথার অবসানের পথ কী? এখানেও আবার ফিরে আসবে ইতিহাসের প্রসঙ্গ। আন্দোলন, বিক্ষোভ এবং সশস্ত্র বিপ্লব। এক যুগ আগে যে-কারণে দাসত্বের অবসান করতে বাধ্য হয়েছিল ইউরোপিয় শক্তিগুলি, ঠিক সেই পথেই হাঁটছেন মালির দাস শ্রেণির একাংশ। যাঁরা মালিকদের ছত্রছায়া পেরিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন, তাঁরা যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীতে। ফলে ক্রমশ বেড়ে চলেছে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। এই রক্তক্ষয় কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল? প্রশাসনের সামান্য উদ্যোগই হয়তো বদলে দিতে পারত গোটা পরিস্থিতিটাকে। কিন্তু স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে কবেই বা কিছু ভেবেছে মানব সভ্যতা?
Powered by Froala Editor